
বাঙলার লোক-সঙ্গীত
ভাওয়াইয়া গান উত্তরবঙ্গ-তথা কুচবিহারের নিজস্ব সম্পদ। উদাস হাওয়ার মতো এর সুরের গতি, তাই এর নাম ভাওয়াইয়া। অজ্ঞাতনামা কবির রচিত এই গান যে শুধু উত্তরবঙ্গের প্রাণের জিনিস বলে তাদের আদর পেয়েছে তা নয়- এই গানের ভেতর সত্যিকারের কবিতা, এই গানের সুরে সত্যিকারের উদাস করা ভাব সারা বাংলার অন্তর- বাণীর তারে এক অভূতপূর্ব স্পন্দন তুলেছে; কারণ এ শুধু কল্পনা-বিলাস নয়, এ হচ্ছে মানব-হৃদয়ের চিরন্তন সত্যের প্রতিচ্ছবি তার সুখ-দুঃখ-বিজড়িত জীবনের অকৃত্রিম চিত্রলেখা।
যাঁরা পূর্ববঙ্গের গানের সঙ্গে পরিচিত, উত্তরবঙ্গের গান শুনলে তাঁরা এক নূতন রসের আস্বাদ পাবেন। আকাশ-ছোঁয়া পাহাড় আর কূল হারানো নদী, দুইই প্রকৃতির সৌন্দর্য ও বিস্ময়ের অপরূপ লীলা; কিন্তু তাদের পার্থক্য অনেক- উত্তরমেরু ও দক্ষিণমেরুর মতোই এদের ব্যবধান। পরিপূর্ণ যৌবন আবেগ-উচ্ছলা ভরা নদীর সুরের সঙ্গে উপল-নূপুর- মুখরিত চটুল পাহাড়ি ঝর্ণার মিল কোথায়? এ যেন কৈশোর ও যৌবনের তারতম্য।
কাজে কাজেই উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া গানের বিচার করতে গেলে সকলের আগে উত্তরবঙ্গের মানচিত্রের দিকে আমাদের চাইতে হয়। মাথার উপরে উন্নত বিরাট পাহাড় মেঘের জটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে- সেই ধূসর পাহাড়ের পাদদেশে শাল সেগুনের অরণ্যানী। দক্ষিণের প্রচণ্ড বাতাস সেই ঘন বনস্থলীকে আলোড়িত করে চালিয়েছে তার বিরাট অভিযান। খেয়ালি প্রকৃতির এই দুরন্তপনার ভিতরে এই গান জেগে ওঠে বিদ্যুতের মতো ধারালো সুরে- মহিষের পিঠে-চড়া হাজারো মৈশালের দীপ্ত কণ্ঠ-শিখায়। সেই সুরে সুর মিলিয়ে বেজে ওঠে কত বেণু, কত দোতারা।
আধুনিক সভ্য জগতের অভিযান আজো সেখানে পৌঁছোয়নি। গ্রাম্য বধূ কাঁধে কলসি নিয়ে জলকে চলে সেই গান শুনতে শুনতে; মাঠে চাষীর দল খুঁজে পায় এই গানে তাদের কর্ম-প্রেরণা; এই গানকে অবলম্বন করে রচিত হয় তাদের নিজ নিজ জীবনের ছোট- খাটো বিচিত্র কাহিনী; তাদের অব্যক্ত মনের একান্ত বারতা মূর্ত হয়ে ওঠে এই গানের ভাষাতেই।
গরুর গাড়িতে গাড়োয়ান উজান দেশে যায় বাণিজ্য করতে- সামান্য দু’একদিনের বিরহ তাই-ই হয় অসহ তার দয়িতার কাছে; সে গেয়ে উঠে :
ওকি গাড়িওয়াল ভাই-
কত রব আমি পন্থের দিকে চায়ারে!
যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়-
নারীর মন মোর ঝুইরা রয়রে,
ওকি গাড়িয়াল ভাই-
হাকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে রে !!
আর কী কব দুষ্কের জ্বালা
গাড়িয়াল ভাই
গাঁথিয়া চিকন মালা রে
ওকি গাড়িয়াল ভাই-
কত কাঁদিম মুই নিধুয়া পাথারে রে !!
উত্তরবঙ্গ- তথা কুচবিহারের ভাওয়াইয়া গান এদের নিজস্ব হৃদয়ের সত্যিকারের বাহন। চাষী ধান কাঠছে মাঠের মাঝখানে; গেয়ে উঠলো দু’টো লাইন- কী তার সুর, কী তার কথা—
ও ধন মোর কানাইয়া রে-
ওরে, আষাঢ় শাওন মাসে
দেওয়া করে কানাই মধু রসে রে-
হায়রে হায়- বুকের বসন মোর হাওয়ায় ধরিয়া টানে-
ও ধন মোর কানাইয়া রে- ॥
ভদ্রবেশে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াইতে গান যায় থেমে।...
‘কী বাহে কন না আরো খানেক?”
“এ্যাঁ : ছাড়ো হামার গান”
আবার গাইতে বল্লেই লজ্জায় তার চোখ মুখ হয়ে ওঠে রাঙা। -ক- তো সাধ্য সাধনা করে এলোমেলো গানের অস্থায়ী অন্তরা গেঁথে নেতে হয় মনে মনে। যাঁরা ভাওয়াইয়া গানের সাথে বেশি পরিচিত নন- তাঁদের কাছে এর বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে দেখা যায় এই শ্রেণীর গানের বিশিষ্ট সুর রচনাও অন্যতম আকর্ষণ। শিক্ষিত নাগরিক কবির চশমা পরে- এই সহজ অনাড়ম্বর বাণী সেবকের পরিচয় পাওয়া যায় না। ক্ষুরধার পন্ডিতি সমালোচনার ছুরি চালালে ভাওয়াইয়া কবিতার কাব্য-লক্ষ্মী যান দূরে পালিয়ে। কোমল হৃদয়ে বুদ্ধি বা পান্ডিত্যের অভিযান অসহ্য হয়ে ওঠে। প্রাণ দিয়ে যাঁরা প্রাণকে বুঝতে চান- ভাওয়াইয়া কবির সহজ হৃদয় অতি সহজেই তাঁদের কাছে ধরা পড়ে। তাই রেঁস্তোরা বা ক্লাবে বসে প্রাণহীনভাবে একে আবৃত্তি করা চলে না। মন যখন একান্ত মনের বশে- তখনই ভাওয়াইয়া গানের অলকানন্দা মনের কূল ভাসিয়ে নেমে আসে।
ভাওয়াইয়া গান শুনতে শুনতে মনে হয় কোথায় যেন কোন আকস্মিক বেদনায় আচমকা যায় সুর ছিঁড়ে- যা অব্যক্ত, যা প্রকাশের নয় তাকে যেন আর প্রকাশ করা চলে না; তার কণ্ঠ আসে ভিজে- ইংরেজিতে বলতে গেলে ‘Silence is more eloquent than speech.-’ সুরের দিক দিয়ে এইটিই ভাওয়াইয়ার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।
এবার কয়েকখানি গানের নমুনা দিচ্ছি। তোরষা নদী মানসাই নদীর মোহনায় কিষাণদের বসতি। তিন বোনে ঢেঁকিঘরে ধান ভানছে। এমন সময় তারই ধার দিয়ে পায়ে-চলা বাঁকা পথে তরলা বাঁশের বাঁশি হাতে নিয়ে গোচারণে গান গেয়ে চলেছে নবীন রাখাল। তার অনুসন্ধানরত চঞ্চল বনমৃগের মতো দু’টি আঁখি এদিকে ওদিকে চায় কার খোঁজে?- যার খোঁজে, সে কিন্তু হাতের কাজে মন দিতে পারে না- ঢেঁকিঘরে দুই বোন কাজের স্রোতে ভেসে চলে। একজন ভেসে চলে চোখের জলের স্রোতে; তার সোনা বন্ধু যে তারই উদ্দেশ্যে গান গেয়ে যায়- মন কি আর কাজে বশ মানে? সে কেঁদে বলে, 'দিদি তোরা বেশ আছিস- কিন্তু আমার অবস্থা একবার ভেবে দেখতো; সোনার বন্ধু- আমার মনের মধ্যে যে আসল মন সেই-ই কিনা কেঁদে চলে গেল- কিন্তু সাড়া দিতে পার্লম কৈ? কুলের বাঁধন, ঘরের শাসন, লোকলজ্জা আমার পথ রোধ করেছে- এ ব্যথা আমি কেমন করে ভুলি?”
এ যেন কৃষ্ণ-সুখ-বঞ্চিতা শ্রীরাধিকা- দূরের বাঁশির কান্না শুনে জটিলা-কুটিলার ভয়ে মনের আগুন চোখের জলে নেভাতে চায়; কিন্তু মনের আগুন, সেকি ছাই নেভে? তাই কেঁদেই যায় তার জন্ম– কেঁদেই যায় তার জীবন! ভাওয়াইয়া কবি কাব্য-দৃশ্যের পটভূমি বড় সুন্দর করে এঁকেছেন : জাপানি পটুয়ার মতো দু’একটি তুলির নিপুণ টানে- যা প্রকাশের নাগালের বাইরে তাও যেন প্রকাশ পেয়েছে :
তোরষা নদীর পারে পারে ও
দিদিলো মানসাই নদীর পারে
আজি সোনার বন্ধু গান করি যায় ও-
দিদি তোরে কি মোরে
কি শোনেক দিদি ও!!
বড় বইনে ভুকায় ঢেঁকি ও
দিদিলো মাইজান বোনে ঝাড়ে,
আর ছোট বোনের চোখের পানি ও
দিদি হিড়িস বাঁধি পড়ে-
দিদি তোরে কি মোরে
কি শোনেক দিদি ও- !
কেমন করি ডাকা দিদি ও
দিদি ও ঐদি ঐদি যায়
মোর বুকের আগুন জ্বলে দিয়া যায়
দিদি তোরে কি মোরে
কি শোনেক দিদি ও !!
বৈষ্ণব কবিদের নৌকাবিলাসের অনেক মধুর কাব্য গীতিকা আমরা শুনেছি- কিন্তু ভাওয়াইয়া কবির নৌকাবিলাস সম্পূর্ণ নূতনত্বে সমৃদ্ধ। চতুর কানাই শ্রীরাধিকাকে সেদিন ‘নাওয়ে’ তুলেছেন। রসিকা শ্রীমতী বিপরীত মুখে অর্থাৎ ‘আগা নাওয়ে’ গিয়ে বসলেন- রসের নাবিক কানাই-এর সম্পূর্ণ নাগালের বাইরে। ছলে, কৌশলে শ্রীকৃষ্ণ চান রাধাকে একান্ত সান্নিধ্যে- তাই ছল করে বললেন, “আগা নাওয়ে ডুবুডুবু পাছা নাওয়ে বইস?” এই রসালাপের মাধুর্য অনেকখানি। গীতি-নাট্যের ভঙ্গিটুকু সুন্দর পরিস্ফুট হয়েছে গীতি-আলাপনের মাঝ দিয়ে। তাতেও যখন শ্রীরাধা ধরা দিলেন না তখন সময় বুঝে একান্ত প্রয়োজনেই ‘সেউতী’র দড়ি ছিঁড়লো। দড়ি আর কোথায় পাবেন- তাই শ্রীমতীর কণ্ঠহারের প্রয়োজন হলো- গলার হার খসিয়ে ‘সেঁউতী’র দড়ি করবার বাসনা করলেন। শ্রীমতীকে বাহুবন্ধনে পেতে হবে তাই না এই কৌশলের অবতারণা! প্রেমিকের লোভ সেই কণ্ঠহারের প্রতি নয়, প্রেমিকার কণ্ঠলগ্ন হওয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু এ প্রচেষ্টাও হলো ব্যর্থ। তখন কৃষ্ণ বুঝলেন- খুলে বলাই ভালো। তাই বললেন- তোমার প্রেম বইবার মতো শক্তি আমার আছে। আমার বলিষ্ঠ মন তোমার প্রেম বরণে সম্পূর্ণ সক্ষম। এ নৌকায় রাজার হাতিকে আমি পার করেছি- কৃষ্ণ জীবন-তরণী রাধা-প্রেমের বোঝা বইতে পারবে। কী চমৎকার উপমা। এরপর চতুর-শিরোমণি দাবি করে বসলেন! কানের সোনা আর গলার মালা। খেয়া ঘাটের কড়ি চাইতো এখানে বলে রাখছি যে, উত্তরবঙ্গ তথা কুচবিহারের মেয়েরা পুরাকালে যে-পুরুষকে পতিরূপে বরণ করতো একমাত্র তারই হাতে কানের সোনা বা গলার হার খসিয়ে নিতো। শ্রীকৃষ্ণের চরম দাবি শ্রীরাধা নিশ্চয়ই অস্বীকার করেননি।
ঢোঙায় ঢোঙায় ছ্যাকোঙ জলরে ।
জল ছেকিতে জল ছেকিতে সেউতীর
ছিঁড়িল দড়ি,
গলার হার খসেয়া কন্যাহে-
ও কন্যা- সেউতীত লাগাঙ দড়ি
গলার হার খসেয়া কন্যাহে ॥
স্ত্রী: তোক্ সে বলোঙ ছাওয়াল কানাই
তোর সে ভাঙ্গা নাও,
ভাঙা নাওয়ের খেওয়া দিয়া হে
ও তুমি- কেমন মজা পাও-
ভাঙা নাওয়ের খেওয়া দিয়া হে !!
পুরুষ: ভাঙাও নোওয়ায় ফুটাও নোওয়ায়
সোনারূপায় গড়া-
রাজার হস্তীক পার করিচোঙরে ॥
ও কন্যা- তোর বা কত ভরা-
রাজার হস্তীক পার করিচোঙরে ॥
এক সুন্দরীকে পার করিতে নিচোঙ আনা আনা
তোক সুন্দরীক পার করিয়া হে !!
সোনাও খসাইম রুপাও খসাইম
খসাইম্ গলার মালা,
ভরা নদীর খেওয়া দিয়া হে
ও কন্যা শরীর হৈল মোর কালা-
ভরা নদীর খেওয়া দিয়া হে !!
বিশ্বের প্রথম শোক-বিহ্বল কবিতা হ’লো ক্রৌঞ্চ-বিরহ অবলম্বনে। সেই তমসা-তীর ক্রৌঞ্চমিথুনের মধুর চিত্র- এমন সময় একটির বুকে এসে লাগলো নির্দয় ব্যাধের নির্মম তীর। আসন্ন বিয়োগ ব্যথায় ক্রৌঞ্চ-বধূর মর্ম-বেদনায় বসুন্ধরার চোখে এলো জল। এই করুণ ছবি দেখে দস্যু রত্নাকর হলেন বাল্মীকি! বাঁধন ভেঙে প্রথম সেই দিন নেমে এলো কাব্যের সুরধুনী। কবি তাঁর কবি প্রতিভাকে অনেক সময় Symbolism-এর মারফত ফুটিয়ে তুলতে চান; পাখি, নদী, ফুল, প্রভৃতির ছদ্ম-সাজে মানুষ তার নিজের কথাই বলে যায়। কাব্য-লোকের ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমী, সাত ভাই চম্পা আর তাদের বোন পারুল বা অশ্রুমতী নদীর মুখে সুখ-দুঃখ-বিজড়িত সে সব কাহিনী আমাদের হৃদয়কে অভিভূত করে, তা চিরন্তন মানুষের নিজের কথাই। অভাবনীয় পথে কাব্যের ঘোড়া ছোটানোর শক্তি আমাদের দেশের ভাওয়াইয়া কবিদের কম নয়।
ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কাঁন্দে রে-
ফান্দ বসাইছে ফান্দি রে ভাই
পুঁটিমাছ দিয়া,
ওরে মাছের লোভে বোকা বগা
পড়ে উড়াল দিয়া রে ॥
ফান্দে পড়িয়া রে বগা করে টানা টুনা
আহারে কুমকুড়ার সূতা হলু লোহার গুণা রে
ফান্দে পড়িয়া রে বগা করে হায় রে হায়
আহারে দারুণ বিধি সাথী ছাইড়া যায় রে ॥
উড়িয়া যায় চখোয়ারে পঙ্খী বগীকে বলে ঠারে
তোমার বগা বন্দী হইছে ধর্লা নদীর পাড়ে রে।।
এই কথা শুনিয়া রে বগী দুই পাখা মেলিল
ধর্লা নদীর পাড়ে যাইয়া দরশন দিল রে-
বগাকে দেখিয়া বগী কান্দে রে
বগীকে দেখিয়া বগা কান্দে রে।
(সংকলিত, উৎস: বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ও শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত “বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্য”, দ্বিতীয় খণ্ড)
হদিস: সাহিত্য ত্রৈমাসিক “প্রেক্ষণ”, (জুলাই - সেপ্টেম্বর, ২০১২)