মেন্যু
Menu

আব্বাসউদ্দীনের আত্মজৈবনিক স্মৃতি

১ জানুয়ারী, ২০২৫

আমার শৈশবের অমলিন স্মৃতি

ধনীর ঘরের দুলাল না হলেও বাবার অবস্থা মোটামুটি ভালো। পঁচিশ-ত্রিশখানা হালের গরু, প্রায় দেড় শ’ বিঘা খাস আবাদি জমি আর পাঁচ হাজার বিঘা প্রজাপত্তনি জমির মালিক ছিলেন তখন আমার বাবা। এত বড় সম্পত্তি দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকার, পাইক, বরকন্দাজ রেখেও বাবা ওকালতি ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি তখন ফিফথ ক্লাসে পড়ি।

এই রকম অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। আমাদের শৈশবটা কীভাবে কেটেছে এখনকার ছেলেরা হয়তো সে কথা ভাবতেও পারে না। তখনকার দিনে, মানে ১৯১৪-১৫ সালে, ধুতি পরতাম, ধুতি ছিল একখানা, গায়ে ছিল একটা শার্ট। আমাদের গ্রামে বলরামপুরের স্কুলটা প্রকাণ্ড এক পুকুরের ধারে। সকাল দশটায় ভাত খেয়ে স্কুলে গিয়ে বইপুঁথি রেখে স্কুলের প্রায় সব ছেলেই শার্ট আর ধুতি পুকুরের পাড়ে রেখে দিগম্বর হয়ে পুকুরে লাফিয়ে পড়তাম। চোখ দুটো জবাফুলের মতো লাল না হওয়া পর্যন্ত সাঁতার কাটতাম। তারপর পণ্ডিত মশায়, যিনি সকাল থেকে বেলা এগারোটা পর্যন্ত নিজের সামান্য জমিতে হালচাষ করে স্কুলে আসতেন, তাঁর গর্জন শুনে পুকুর থেকে উঠতাম। পাঁচ-ছয় দিন পরে পরে পুকুরে নামবার আগেই ধুতি কেচে শুকোতে দিতাম, তারপর সেই ধুতি পরতাম। জুতা বলে কোনো জিনিস গ্রামে ব্যবহারও হতো না, আমাদের দরকারও হতো না। প্রত্যেক হাটের বার বাবা আমাদের দুটি করে পয়সা দিতেন। এক পয়সায় দশ গণ্ডা মানে চল্লিশটা মোয়া কিনতাম, আর এক পয়সায় বাতাসা, তাও প্রায় পঁচিশ-ত্রিশটা। এই দিয়ে ভোর সকালবেলা হতো আমাদের নাস্তা। আট মাস-দশ মাস পরে নতুন শার্ট বা ধুতি পেতাম। সেই নতুনের গন্ধ যাতে ফুরিয়ে না যায় সে জন্য কাপড় প্রথম পানিতে ভেজাতাম তা প্রায় পনের-বিশ দিন পরে। বাবুগিরি কাকে বলে হাইস্কুলে না যাওয়া পর্যন্ত জানতাম না।

আগেই বলেছি, আমাদের বাড়ির পুবে দিগন্ত-ছোঁয়া মাঠ- তারপর বয়ে চলেছে কালজানি নদী। বর্ষায় চেয়ে চেয়ে দেখতাম তার অপরূপ শোভা। সারাটা মাঠ সবুজ ধানে ভরে উঠত। পুবালি বাতাসে সেই ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলে যেত। সাদা মেঘ নদীর পাড়ে বৃষ্টির জাল বুনতে বুনতে আসত মাঠের মাঝখানে, পড়ত আমাদের বড় বড় টিনের ঘরে ঝমঝম ঝমঝম শব্দে। তখনকার দিনের বৃষ্টির কথা জীবনে ভুলতে পারব না। বৃষ্টি যখন আরম্ভ হতো- এক মাস-দেড় মাসের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্য বিরাম হতো না। অনেকের বাড়িতে জ্বালানি কাঠ থাকত না। বর্ষার আগে তাই দশ-পনেরো দিনের উপযোগী চিড়া-মুড়ি তৈরি করে রাখত অনেকে। বৃষ্টিতে ভিজতাম, বড় ভালো লাগত অহেতুক বৃষ্টিতে ভিজতে। কোনো কোনো বছর বৃষ্টিতে ভেজার জন্য হতো সর্দি, জ্বর, কখনো বা ম্যালেরিয়া। ছেলেরা দল বেঁধে বড়শি নিয়ে যেতো মাঠের দিকে, আমারই নাকের ডগার ওপর দিয়ে, শুয়ে শুয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করতাম জ্বরের বিরুদ্ধে। তখনকার দিনের ম্যালেরিয়ার একমাত্র সুহৃদ ছিল ‘ডি, গুপ্তের টনিক’। মাকে বলতাম, ‘হোক তেতো, বেশি করে ওষুধ দাও, জ্বরটা তাড়াতাড়ি মরে যাক। দেখো না সবাই কেমন মাছ ধরতে যাচ্ছে- আমি ক’দিন থাকব বিছানায় শুয়ে?’ মা বলত, ‘পাগল ছেলে, একসঙ্গে এক দাগের বেশি ওষুধ খেলেই কি জ্বর পালিয়ে যায়? নিয়ম মতো খেতে হয়।’

বসন্তের কোকিল-ডাকা প্রভাতবেলায় কে আমায় ধরে রাখতে পেরেছে ঘরের মায়ায় বন্দী করে? কত ভোরে উঠে একাই বেরিয়ে পড়তাম- দুধারে বিরাট বিরাট শিশুগাছের এভিনিউ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকাণ্ড রাস্তার ওপর দিয়ে প্রায়ই নদীর পাড় পর্যন্ত। অত ভোরে কোকিল, বউ কথা কও, ফটিক জল, ঘুঘুর ডাক- সারাটা গ্রামে যেন পাখির ডাকের ঐকতান বেজে উঠত। গ্রামে জীবনে কেউ পাখি মারার জন্য বন্দুকের আওয়াজ কখনো শোনেনি। তাই গ্রামে বসত বেঁধেছে নানা পাখির দল নির্ভয়ে।

গরমের দিনে কাছারিঘরের বারান্দার নিচে বেঞ্চ পেতে শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে থাকতাম অনন্ত নীল আকাশের দিকে। একেক সময় মনে হতো মাথার ওপর এই নীল আকাশটা কেন? ওটার ওপরে যেখানে আর কিছুই নেই, অমন নীল রাজ্যও নেই, সেখানে যেতে পারব না কোনো দিন? মন তখনই ছিল কল্পনাপ্রবণ! ঘর থেকে দেখা যেত হিমালয় পাহাড়, আকাশের মতোই নীল। মনে হতো, আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে আরেকটা নীল আকাশ ঘুমিয়ে আছে। ওই নীলের কি শেষ নেই? অসংখ্য চিল উড়ত মাথার ওপর সেই মহাশূন্যে। ভাবতাম, আমারও যদি অমন পাখা হতো, কী মজার হতো! এই ছোট্ট গ্রামে আমাকে বেঁধে রাখতে পারত না- উড়তাম, উড়তাম, উড়তাম।

দিনের বেলা এমন কতশত কল্পনা মনে জাগত। জ্যোৎস্না রাতেও মনে হতো চাঁদের দেশে যাব, ওই ছোট ছোট তারার দেশে যাব; কিন্তু আঁধার পক্ষ এলেই সব গুলিয়ে যেত অর্থাৎ যত কল্পনা সব ছুটি নিত মন থেকে। অতি শৈশব থেকে ভাবপ্রবণ ছিলাম আমি। বিছানায় শোয়ামাত্র আর সব ছেলে যেমন ঘুমিয়ে পড়ত, আমার ঠিক তা হতো না। ঝিঁঝি পোকার ডাকটা যেন মনে হতো রাত্রির গান। তাই সন্ধ্যা হলে খাইয়েদাইয়ে মা বিছানায় যেতে বললেই যে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম, তা নয়। চুপটি করে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, বড়রা যখন খেয়েদেয়ে শোবে, আর কোনো রকম শব্দ হবে না কারোর, তখন শুনব ঝিঁঝি পোকার গান। এ গান সারা প্রাণ দিয়ে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম।

শুধু কি তাই? ভোরবেলা, বিশেষ করে শীতের রাতে অতি ভোরে গ্রামে যখন প্রথম মোরগটা ডেকে উঠত, সেই মোরগের ডাক থেকে এর ডাকে আরেকটা, তার ডাক শুনে বহুদূরের বাড়ির আরেকটা মোরগ ডেকে উঠত, তখন মনে হতো ওই অত ভোরে এরা কে কাকে কী বলছে? মাকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘মা, মোরগগুলো কী বলে?’ মা বলতেন, ‘সত্যকাল হোক।’ এখন ভাবছি, সত্যকাল তখনই ছিল- সে কাল তো আর এখন নেই! অত ভোরে শীতের দূরগ্রামে শিঙা ফুঁকত কী করুণ মিষ্টি সুরে! ‘অত ভোরে ওঠে কেন ওরা, ওটা কী বাজায়?’ মাকে জিজ্ঞেস করতাম। মা অনেক সময় বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘আহ্, ঘুমাও বাবা- এখনো অনেক রাত আছে। ওরা শিঙা বাজাচ্ছে, আজ হয়তো কোথাও বাহইতে নদী মারবে।’ এ কথায় অর্থ বুঝতাম না। বয়স হলে বুঝেছি- ভোরবেরা ওই শিঙা ফুঁকালে বহু গ্রামের লোক একসঙ্গে সেদিন কোনো বিল বা নদীর ছড়ায় দল বেঁধে মাছ মারবে। ভাওয়াইয়া গানের একটা লাইনে পাওয়া যায়- ‘ওরে বাহইতে নদী মারে জোর শিঙা দিয়া রে’।

তারপর ডেকে উঠত শিয়াল। এক শিয়াল ডেকে উঠল, হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া... অমনই কিছু দূরে আরেকটা, তারপর খানিকটা দূরে আরেকটা, তারপর মনে হতো গ্রামে শুধু বুঝি শিয়ালই থাকে। আরম্ভ হলো সব্বাই মিলে হুক্কা হুয়া হুক্কা হয়া, শেষে শুধু হুয়া হুয়া হুয়া। মনে হতো সবাই মিলে যাত্রাগানের ছেলের দলের মতো কোরাসে যেন গান ধরেছে।

শীতকাল চলে গেলে। এল ফাল্গুন মাস। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায়। গ্রামে তো আর গাছগাছালির অভাব নেই। সেই সব গাছ থেকে ভোরে ডেকে ওঠে কী মিষ্টি সুরে কোকিল, শ্যামা, দোয়েল আর পাপিয়া। সকাল হয়। বিছানা থেকে উঠে ভাইবোনদের কাছে কোকিলের সুর নকল করে বলে উঠতাম – কু-কু-কু!

আসে বোশেখ মাস। আকাশের উত্তরে মেঘ জমে- রাতে আসে ভীষণ ঝড়। ঝড় থেমে যায়- আকাশে চাঁদ ওঠে। বাড়ির উত্তরে কাঁঠালগাছটার ওপর দিয়ে একটা পাখি উড়ে যায়, গেয়ে যায়, ‘বউ কথা কও, বউ কথা কও’। কী মিষ্টি সুর, বুকটা যেন মোচড় দিয়ে উঠত! আহা অমন মিষ্টি করে যদি আমি গাইতে পারতাম!

জষ্টি মাসের কাঠফাটা রোদ্দুর। মা বলতেন, ‘খবরদার, এই দুপুর রোদ্দুরে কোথাও বেরুবি নে, ঘরে শুয়ে থাক, ঘুমোও।’ মটকা মেরে ঘুমাবার ভান করে শুয়ে থাকি। পুবের ঘরের পাশে বড় আমগাছটায় ঘুঘু ডাকতে থাকে, ঘুঘু ঘুটু ঘুঘু ঘুটু... মনটা যেন কেমন করে ওঠে; ওপাশে গোলাঘর, পায়রাগুলো গেয়ে উঠত বাক বাকুম কুম কুম-বাক বাকুম কুম!

জষ্টি মাসের শেষ, এই আষাঢ় মাসের প্রথমের দিকটায় আমাদের পুকুরের পানি বৃষ্টির পানিতে কানায় কানায় ভর্তি না হলেও বেশ পানি থইথই হয় আর কি! পুকুরের পাড়ের নিচু জমিগুলো পানিতে ডুবে যায়। পাশে বাঁশঝাড়। ভোরবেলা আম কুড়োতে যেতাম, পুকুরের পাড়ের নিচু জমি যা বৃষ্টির পানিতে ভর্তি হয়ে আছে, সেসব জায়গায় দেখি হলুদ গায়ে মেখে ইয়া বড় বড় ব্যাঙ একটা আরেকটার পিঠে চড়ে কী মিষ্টি একটানা গান জুড়ে দিয়েছে, কী ঘ্যাকোঙ কি ঘ্যাক, কী ঘ্যাকোঙ কি ঘ্যাক! ওরে আম কুড়াব কি, থ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি ওদের কাণ্ডকারখানা! একটা-দুটো কি ব্যাঙ, রাশি রাশি হাজার হাজার শত শত, কতশত তখন কি ছাই গুনতে শিখেছি! মোট কথা, মনে হচ্ছিল হলুদ গায়ে মেখে যেন হলদে পরির বাচ্চারা আনন্দে গান গেয়ে চলেছে।

রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমাতে, যাব, আকাশ মেঘে ভর্তি, হয়তো বা বৃষ্টি আসবে, হঠাৎ কানে এল সেই ব্যাঙের ডাক, থামে না, কী মিষ্টিমধুর মনে হতে লাগল! একটানা সেই সুর, তার সঙ্গে ঝিঁঝি পোকার সুর, সেই সুর শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম।

ছোট্টবেলা থেকে ওই মোরগের ডাক, শিয়ালের ডাক, শিয়ালের ডাক, ঘুঘুর ডাক, পায়রার ডাক, ব্যাঙের ডাক, কোকিল, দোয়েল, বউ কথা কও, পাপিয়ার সুর শুনে শুনে আমার গলায় সুর বাসা বেঁধেছিল। এমনকি স্কুলের যখন ঘণ্টা পড়ত, সেই ঘণ্টার শব্দের শেষ সুরটুকু- ঢং.... এর অং.... টুকু গলায় তুলে নিতাম।

আমার শৈশবের সেই কল্পনাপ্রবণ মন আজ হাতড়ে দেখি কোথায় কবে বিদায় নিয়েছে। শত জঞ্জালে চিরকালের জন্যই হয়তো ও মনের চিরসমাপ্তি ঘটেছে। অথচ মনে হয় এই তো সেদিনকার কথা।

‘পাগারু’ নামে এক বুড়ো খুব ভালো দোতারা বাজিয়ে গান গাইত। প্রথম দোতারা বাজনা তার কাছে শুনি। গান গেয়ে যখন সেই সুরটা দোতারায় বাজাত, মনে হতো, দোতারা নিজেই গেয়ে উঠল। গ্রামে কোনো বাড়িতে পাগারুর গান হলে, বাড়িতে ধরে রাখে কার সাধ্য? কুশান গান অর্থাৎ পালাগান প্রথম শুনি অতি ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের বন্দরে। ছোট ছোট ছেলেরা মেয়ের পোশাক পরে কী সুন্দর নাচে! তাদের নাচগান শুরু হতো সন্ধ্যায়- অবিরাম তিন-চার ঘন্টা নেচে-গেয়েও যেন পরিশ্রান্ত নয় কেউ! কত ছন্দ, কত তাল, কত হাসি, কত প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় সে গানে! সেই কুশান গান গাওয়া হতো খোল, করতাল আর বেণা নামক এক যন্ত্র সহযোগে। এই বেণা জিনিসটা অনেকটা বেহালার মতো। তবে তাতে চারটা তার নেই। একগুচ্ছ ঘোড়ার লেজের চুল দিয়ে এই বেণা তৈরি। গ্রামের বয়োবৃদ্ধ ছেলেদের ধরে গ্রামের এক ঘোড়াকে দড়ি বেঁধে লেজ কাটতে গিয়ে কী বিপদ! একটা ছেলে তো ঘোড়ার লাথি খেয়ে অজ্ঞান! গ্রামের লোক বহু কসরত করে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনে। যাক্, ঘোড়ার লেজ কেটে জোগাড় করতে পেরেছি ‘বেণা’ তৈরির সরঞ্জাম, মনে কী স্ফূর্তি! তারপর বেণা তৈরি করে বেণা বাজিয়ে যেদিন গান গাইতে শুরু করলাম, সেদিন আরও কী আনন্দ! বাবা তো একদিন বলেই বসলেন, ‘তুই কি গান-বাজনাই করবি, পড়াশোনা করবি নে?’

ইসলামি গান : আমি ও কাজীদা

কাজীদার লেখা গান ইতিমধ্যে অনেকগুলো রেকর্ড করে ফেললাম। তাঁর লেখা ‘বেনুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধর’, ‘অনেক কিছু বলার যদি দুদিন আগে আসতে’, ‘গাঙে জোয়ার এল ফিরে তুমি এলে কই’, ‘বন্ধু আজও মনে রে পড়ে আম কুড়ানো খেলা’ ইত্যাদি রেকর্ড করলাম।

একদিন কাজীদাকে বললাম, ‘কাজীদা, একটা কথা মনে হয়। এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কালু কাওয়াল- এরা উর্দু কাওয়ালি গায়, এদের গানও অসম্ভব বিক্রি হয়, এই ধরনের বাংলায় ইসলামি গান দিলে হয় না? তারপর আপনি তো জানেন কীভাবে কাফের কুফর ইত্যাদি বলে বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে অপাঙক্তেয় করে রাখার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে একদল ধর্মান্ধ! আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানের ঘরে-ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান।’

কথাটা তাঁর মনে লাগল। তিনি বললেন, ‘আব্বাস, তুমি তগবতীবাবুকে বলে তাঁর মত নাও, আমি ঠিক বলতে পারব না।’ আমি ভগবতী ভট্টাচার্য অর্থাৎ গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল-ইনচার্জকে বললাম। তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘না না না, ওসব গান চলবে না। ও হতে পারে না।’ মনের দুঃখ মনেই চেপে গেলাম। এর প্রায় ছয় মাস পরে।

একদিন দুপুরে বৃষ্টি হচ্ছিল, আমি অফিস থেকে গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল ঘরে গিয়েছি। দেখি, একটা ঘরে বৃদ্ধা আশ্চর্যময়ী আর বৃদ্ধ ভগবতীবাবু বেশ রসাল গল্প করছেন। আমি নমস্কার দিতেই বৃদ্ধ বললেন, ‘বসুন বসুন।’ আমি বৃদ্ধের রসাপুত মুখের দিকে চেয়ে ভাবলাম, এ-ই উত্তম সুযোগ। বললাম, ‘যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলি। সেই যে বলেছিলাম ইসলামি গান দেওয়ার কথা, আচ্ছা, একটা এক্সেপেরিমেন্টই করুন না, যদি বিক্রি না হয় আর নেবেন না, ক্ষতি কি?’ তিনি হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি, আচ্ছা আচ্ছা, করা যাবে।’

শুনলাম, পাশের ঘরে কাজীদা আছেন। আমি কাজীদাকে বললাম যে ভগবতীবাবু রাজি হয়েছেন। তখন সেখানে ইন্দুবালা কাজীদার কাছে গান শিখছিলেন। কাজীদা বলে উঠলেন, ‘ইন্দু, তুমি বাড়ি যাও, আব্বাসের সঙ্গে কাজ আছে।’ ইন্দুবালা চলে গেলেন। এক ঠোঙা পান আর চা আনতে বললাম দশরথকে। তারপর দরজা বন্ধ করে আধঘন্টার ভেতরই লিখে ফেললেন, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’। তখনই সুরসংযোগ করে শিখিয়ে দিলেন। পরের দিন ঠিক এই সময় আসতে বললেন। পরের দিন লিখলেন, ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর’।

গান দুখানা লেখার ঠিক চার দিন পরই রেকর্ড করা হলো। কাজীদার আর ধৈর্য মানছিল না। তাঁর চোখেমুখে কী আনন্দই যে খেলে যাচ্ছিল! তখনকার দিনে যন্ত্র ব্যবহার হতো শুধু হারমোনিয়াম আর তবলা। গান দুখানা আমার তখন মুখস্থ হয়নি। তিনি নিজে যা লিখে দিয়েছিলেন, মাইকের পাশ দিয়ে হারমোনিয়ামের ওপর ঠিক আমার চোখ বরাবর হাত দিয়ে কাজীদা নিজেই সেই কাগজখানা ধরলেন, আমি গেয়ে চললাম। এই হলো আমার প্রথম ইসলামি রেকর্ড! দু মাস পর ঈদুল ফিতর। শুনলাম, গান দুখানা তখন বাজারে বের হবে।

ঈদের বাজার করতে একদিন ধর্মতলার দিকে গিয়েছি। বি এন সেন অর্থাৎ সেনোলা রেকর্ড কোম্পানির বিভূতিদার সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, ‘আব্বাস, আমার দোকানে এসো।’ তিনি এক ফটোগ্রাফার ডেকে নিয়ে এসে বললেন, ‘এর ফটোটা নিন তো। আমি তো অবাক! বললাম, ‘ব্যাপার কী?’ তিনি বললেন, ‘তোমার একটা ফটো নিচ্ছি, ব্যস, আবার কি?’

ঈদের বন্ধে বাড়ি গেলাম, বন্ধের সঙ্গে আরও কুড়ি-পঁচিশ দিন ছুটি নিয়েছিলাম। কলকাতা ফিরে এসে ট্রামে চড়ে অফিসে যাচ্ছি। ট্রামে একটি যুবক আমির পাশে গুনগুন করে গাইছে, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’। আমি একটু অবাক হলাম। এ গান কী করে শুনল! অফিস ছুটির পর গড়ের মাঠে বেড়াতে গিয়েছি, মাঠে বসে একদল ছেলের মাঝে একটি ছেলে গেয়ে উঠল, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’। তখন মনে হলো, এ গান তো ঈদের সময় বাজারে বের হওয়ার কথা। বিভূতিদার দোকানে গেলাম। আমকে দেখে তিনি একদম জড়িয়ে ধরলেন। সন্দেশ, রসগোল্লা, চা এনে বললেন, ‘খাও।’ আমার গান দুটো এবং আর্টপেপারে ছাপানো আমার বিরাট ছবির একটা বান্ডিল সামনে রেখে বললেন, ‘বন্ধুবান্ধবদের কাছে বিলি করে দিয়ো। আমি সত্তর-আশি হাজার ছাপিয়েছি, ঈদের দিন এসব বিতরণ করেছি। আর এই দেখো, দু হাজার রেকর্ড এনেছি তোমার।’

আনন্দে-খুশিতে মন ভরে উঠল। ছুটলাম কাজীদার বাড়ি। শুনলাম, তিনি রিহার্সেল রুমে গেছেন। গেলাম সেখানে। দেখি, দাবা খেলায় তিনি মত্ত। দাবা খেলতে বসলে দুনিয়া ভুলে যান তিনি। আমার গলার স্বর শুনে একদম লাফিয়ে উঠে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘আব্বাস, তোমার গান কী যে-’ আর বলতে দিলাম না, পা ছুঁয়ে তাঁর কদমবুসি করলাম। ভগবতীবাবুকে বললাম, ‘তাহলে এক্সপেরিমেন্টের ধোপে টিকে গেছি, কেমন?’ তিনি বললেন, ‘এবার তাহলে আরও ক’খানা এই ধরনের গান... ‘খোদাকে দিলাম কোটি ধন্যবাদ।

এরপর কাজীদা লিখে চললেন ইসলামি গান। আল্লাহ-রাসূলের গান পেয়ে বাংলার মুসলমানের ঘরে-ঘরে জাগল এক নব উন্মাদনা। যারা গান শুনলে কানে আঙুল দিত, তাদের কানে গেল, ‘আল্লা, নামের বীজ বুনেছি’, ‘নাম মুহাম্মদ বোল রে মন নাম আহমদ বোল’। কান থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে তন্ময় হয়ে শুনল এ গান, আরও শুনল, ‘আল্লাহ্ আমার প্রভু আমার নাহি নাহি ভয়।’ মহররমে শুনল মর্সিয়া, শুনল ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ এল রে দুনিয়ায়’। ঈদে নতুন করে শুনল, ‘এল আবার ঈদ ফিরে এল আবার ঈদ, চল ইদগাহে’। ঘরে-ঘরে এল গ্রামোফোন রেকর্ড, গ্রামে-গ্রামে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল আল্লাহ্-রাসূলের নাম।

কাজীদাকে বললাম, ‘কাজীদা, মুসলমান তো একটু মিউজিক-মাইন্ডেড হয়েছে। এবার তরুণ ছাত্রদের জাগানোর জন্য লিখুন।’ তিনি লিখে চললেন, ‘দিকে দিকে পুন: জ্বলিয়া উঠিছে’, ‘শহীদী ঈদগাহে দেখ আজ জমায়েত ভারি’, ‘আজি কোথায় তখতে তাউস, কোথায় সে বাদশাহি’।

ইসলামি গান পাঁচ-ছয়খানা বাজারে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে বহু চিঠি আসতে আরম্ভ করল গ্রামোফোন কোম্পানির ঠিকানায় আমার নামে। কেউ লিখল, ‘হুজুর, কুকুর মার্কা হলুদ রেকর্ড অর্থাৎ টুইনে গান দিলে বারোআনা এক টাকায় আমরা অনায়াসে কিনতে পারি।’

কাজীদাকে বললাম। তিনি তো খুব আপত্তি তুললেন। বললেন, ‘পাগল, এই কিছুদিনের মধ্যেই রেকর্ডে রয়‍্যালটি প্রথা চালু হবে। আর্থিক দিক দিয়ে তুমি ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ আমার শুধু মনে ভাবনা: গরিব মুসলমান যদি বারোআনা এক টাকায় রেকর্ড পায়, হোক গে আমার আর্থিক ক্ষতি, গানগুলো তো ঘরে ঘরে প্রচার হবে। জাগবে ইসলামি ভাব, জাতীয় ভাব। ‘নাহ্, কাজীদা, হোক গে আমার আর্থিক ক্ষতি।’ তখন কোম্পানির সঙ্গে বন্দোবস্ত হলো, আমি টুইনেই গান দেব। তার দরুন রেকর্ডপ্রতি কোম্পানি আমাকে মাত্র এক শ টাকা দিতে রাজি হলো। বাংলার গরিব মুসলমানের মুখ চেয়ে আমি আমার প্রায় প্রতিটি নামকরা ইসলামি গান টুইনে রেকর্ড করেছি। এসব রেকর্ড থেকে তাই ওই এককালীন এক শ’ টাকা ছাড়া অর্থের দিক থেকে আমার কিছু জোটেনি।

কিন্তু প্রতি মাসে একখানার বেশি তো আর গান বের করতে পারে না কোম্পানি। অথচ ইসলামি গানের কী চাহিদা! মাসে দু-তিনখানা বের হলেও বোধহয় সবই সমান বিক্রি হয়। তকরীম আহমদকে নিয়ে এসে তাঁকে দিয়ে চারখানা গান রেকর্ড করিয়ে নিয়েছিলাম। ইতিমধ্যে আবুদল লতিফ নামের একটি ছেলেকে আবিষ্কার করলাম। ভারি মিষ্টি কণ্ঠ, সেও কখানা গান রেকর্ড করল। তিলজালার শাপগাছি গ্রামে তার বাড়ি। দুঃখের বিষয়, ছেলেটি দু-তিন বছর রেকর্ড করেই মারা যায়।

আগেই বলেছি, প্রায় প্রতি মাসেই আমার রেকর্ড বাজারে বের করা শুরু হলো। কিন্তু প্রতি মাসে গান বের হলে একজন আর্টিস্টের গান একঘেয়ে হয়ে যায়। অথচ ইসলামি গান গ্রামোফোন কোম্পানির ঘরে এনেছে অর্থের প্লাবন। তাই মুসলমান গায়কের অভাব বলে ধীরেন দাস সাজলেন গনি মিঞা, চিত্ত রায় সাজলেন দেলোয়ার হোসেন, আশ্চর্যময়ী, হরিমতী- এঁরা কেউ সাজলেন সকিনা বেগম, আমিনা বেগম; গিরীন চক্রবর্তী সাজলেন সোনা মিঞা।

যা হোক, আমার মনে কিন্তু দিনরাত খেলে যাচ্ছে এক অপূর্ব আনন্দোম্মাদনা। এ-ই তো চাই। মুসলমানের ঘুম ভেঙেছে! তারা জেগে উঠে গাইছে, ‘বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা শির উঁচু করি মুসলমান।’ এই তো আমার সারা জীবনের ছিল কামনা।

সবচেয়ে ফ্যাসাদে পড়লাম কে মল্লিককে নিয়ে। আমার জীবনে প্রথম রেকর্ড করার সময় মল্লিক সাহেবই আমাকে উচ্চারণভঙ্গি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি একদিন আমাকে ধরলেন। বললেন, ‘আব্বাস, আমার একটা উপকার করতে হবে, ভাই।’ আমি বললাম, ‘এক শ বার! কী করতে হবে বলুন।’ তিনি বললেন, ‘দেখো, জীবন ভরে শ্যামা বিষয়ে গান গাইলাম, বাংলার মুসলমানদের ধারণা, আমি মল্লিক মশায়, আমি হিন্দু, অনাগত ভবিষ্যৎ বংশধরেরাও জানবে, আমি মল্লিক মশায়। তা ভাই, আমি যে মুসলমান, এটা বলতে আর তো সংকোচের কিছু নেই। এই তো তুমি দিব্যি আব্বাস ‘আব্বাস’ হয়েই ঘরে-ঘরে পরিচিত হলে। তা, আমার দুঃখটা তুমিই পারো ঘুচিয়ে দিতে। এই কাজী সাহেবকে বলে আমার জন্য মাত্র দুখানা ইসলামি গান গাওয়ার বন্দোবস্ত করে দাও, আর সঙ্গে সঙ্গে ভগবতীবাবুকে বলেও দেখো, ও আমি নিজে বলতে পারব না, তুমি যদি ভাইটি-’ আমি বাধা দিয়ে বললাম, ‘আর বেশি বলতে হবে না, আমি আমার প্রাণপণ শক্তি দিয়ে এটা করিয়ে নেবই।’

বললাম কাজীদাকে। কিন্তু কোনো ফল হলো না। তিনি বললেন, ‘আমি পারব না, তুমি যদি ভগবতীবাবুকে রাজি করাতে পারো। কারণ জানো আব্বাস, এই মল্লিক মশায় যদি একবার ইসলামি গান দেন, তাহলে তাঁর শ্যামাবিষয়ক গানে বিক্রির ভাটা পড়ে যাবে।

হিন্দুরা যখন জানতে পারবে কে মল্লিক মুসলমান, তখন তার শ্যামাবিষয়ক গান আর কেউই কিনবে না। জানোই তো, মল্লিক মশায়ের গলার সেই পেটেন্ট টান কিছুতেই যাবে না। ওর রেকর্ড বাজালেই ধরা পড়ে যাবে। তবে দেখো, যদি ভগবতীবাবুকে রাজি করাতে পারো।’

ভগবতীবাবুকে বললাম। তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘মশায়, এ কী কথা! মল্লিক মশায়কেও শেষ পর্যন্ত আপনি! আমি বললাম, ‘আজ্ঞে আমি নই, তিনিই!’

এরপর অবশ্য ভগবতীবাবুর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। বৃদ্ধ বেচারি আমাদের এসব আবদার-অভিযোগের দিকে কান না দিয়ে অকস্মাৎ একদিন পরপারে চলে গেলেন। সে জায়গায় এলেন শ্রীহেমচন্দ্র সোম। এমন উদার মতাবলম্বী বন্ধুবৎসল মানুষ খুব কম দেখেছি। তাঁকে একদিন বলামাত্রই তিনি বললেন, ‘বেশ তো, মল্লিক মশায় বুড়ো হয়েছেন, গ্রামোফোন কোম্পানি লক্ষ লক্ষ টাকা তাঁকে দিয়ে কামিয়েছে। তিনি যদি ইসলামি গান গেয়ে আনন্দ পান, আলবত তাঁকে গাইতে দেওয়া হবে।’

কাজীদা ও মল্লিক সাহেব আমার ওপর সেদিন কী খুশি!

নবজাগরণে বাংলার মুসলমান

সিরাজগঞ্জ যুব কনফারেন্স ১৯৩২ সালে। কাজীদা আর আমাকে সেই সভায় নিয়ে আসার জন্য সৈয়দ আসাদ-উদ্‌-দৌলা সিরাজী এল কলকাতায়। কাজীদা বললেন, ‘তোমার এ আহ্বান কি উপেক্ষা করতে পারি? জানো আব্বাস, সিরাজী হবে বাংলার তরুণদের নকিব। তুমি, আমি, সিরাজী- এই তিনজনে বাংলাদেশ জয় করতে পারি।’

যথাসময়ে সিরাজগঞ্জ এলাম। খুব ভোরে শীতের দিন সিরাজগঞ্জ এসে পৌঁছালাম। কাজীদা স্টেশনের ওয়েটিং রুমের বাথরুমে ঢুকলেন। এক ঘণ্টা গেল আর বের হন না।

ওদিকে চার-পাঁচ হাজার ছাত্র ও জনতা বিরাট শোভাযাত্রা করে দাঁড়িয়ে আছে তাঁকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এক ঘন্টা পর যখন তিনি বের হলেন, তখন আমি কাজীদার অপূর্ব বেশ দেখে হাসি চেপে রাখতে গিয়ে দাঁতে দাঁতে ঠোঁট চেপে ঠোঁট কেটে ফেললাম। খদ্দরের পায়জামা... কবে তৈরি করেছিলেন জানি না, ছোট হয়ে গেছে। খদ্দরের শেরওয়ানি.... এতক্ষণ ধরে বাথরুমে বসে বোধহয় কসরত করছিলেন বৃথাই বোতাম লাগানোর জন্য। শরীর হয়েছে বেশ বপুসদৃশ...ও মান্ধাতার আমলের শেরওয়ানি গায়ে লাগবে কেন? বহু বোতাম বিদ্রোহ করে প্রায় ছিঁড়ি ছিঁড়ি অবস্থা- যে ধারের বোতাম সেই ধারেই দাঁড়িয়ে আছে, ও ধারের ছিদ্রে তারা আত্মসমর্পণ করেনি। যাক, সেগুলো তিনি অতিকষ্টে খদ্দরের উত্তরীয় দিয়ে আবৃত করার জন্য বারবার উত্তরীয়র গায়েই হাত বোলাচ্ছেন। মুখে বিরক্তির চিহ্ন নেই। মাথায় খদ্দরের টুপি। এই বেশে তাঁকে মোটরে, তোলা হলো। ততক্ষণ পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠে সিরাজগঞ্জের আকাশ কাজীদাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করছে। সিরাজগঞ্জের প্রভাত-পাখিরা বিচিত্র কলরবে কোকিল-কবিকে স্বাগত জানাচ্ছে। এদের কলকাকলি ছাপিয়ে বেজে উঠল ব্যান্ডের সুর..... শোভাযাত্রা সেই সুরে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলল শহরের দিকে; কিন্তু চলল আর কোথায়? দুই মিনিট চলে আর থামে। পাঁচ মিনিট বেশ চলে আবার থামে। থামে মানে থামিয়ে দেয়। পুরনারীরা এসে কাজীদার মাথায় এঁকে দেয় তিলকচন্দন। কাজীদা বলে ওঠেন, ‘এই যে এই যে, এ হলো আব্বাস, আমার ভাই, গান, হ্যাঁ, গান শোনাবে।’ আমারও মাথায়, কপালে সবাই ছোঁয়াতে লাগল পুষ্পচন্দন। এমনি করে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে প্রায় চার ঘণ্টা পর মোক্তার আফজাল আলী খাঁ সাহেবের বাসায় নিয়ে আসা হলো আমাদের। সেখানে চা-পর্ব শেষ হলো। দুপুর একটার সময় হলে সভা বসবে। গিয়ে দেখি, বিরাট জনসমুদ্রের মাঝখানে একটা ইমারত দাঁড়িয়ে আছে। সেই জনতা ভেদ করে হলের ভেতর প্রবেশ করলাম। কাজীদার সেদিনের অভিভাষণ বাংলার তরুণদের প্রাণে কী উন্মাদনাই না জাগিয়েছিল! তাঁর কণ্ঠোচ্চারিত জলদগম্ভীর স্বরে সিরাজগঞ্জের তরুণদের ডাক দেওয়াটা মনে হচ্ছিল যেন সারা বাংলার তরুণদেরই ডাক দেওয়া- চল চল চল ওরে চল।

প্রতিটি কথার পর অজস্র করতালি, সভা যেন সজীব। আমি গানের পর গান গেয়ে চললাম। তখনকার দিনে মাইকের প্রচলন ছিল না, ঘরে-বাইরে লোক ভর্তি। বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃতি সেদিন লাভ করলাম সভা-গায়ক হিসেবে। খোদার উদ্দেশ্যে জানালাম কোটি শুকুর। সিরাজগঞ্জের জনসাধারণ সেদিন কাজীদা ও আমার গলায় সিরাজগঞ্জের সব বাগান উজাড় করে ফুল দিয়ে সাজিয়েছিল।

কলকাতায় এসেছেন তুর্কি নারী-জাগরণের অগ্রদূতিকা খালিদা এদিব হানুম। তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য কারমাইকেল হোস্টেলের ছেলেরা মেতে উঠেছে। কাজীদাকে গিয়ে ধরল ছেলেরা, গান লিখে দিতে হবে। তিনি একখানা গান লিখে দিলেন। আমাকে বললেন সুর দিতে। তাঁর সে গানখানা সেদিন খালিদা হানুমের সভায় গেয়ে রেকর্ড করেছি—

গুণে গরিমায় আমাদের নারী আদর্শ দুনিয়ায়

রূপে-লাবণ্যে মাধুরী ও শ্রীতে হুরপরী লাজ পায়।

লক্ষ খালেদা আসিবে যদি এ নারীরা মুক্তি পায় ॥

নাটোর, শান্তাহার তথা উত্তরবঙ্গে নেমেছে প্লাবন। কলকাতার পথে-পথে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে ভিক্ষা করতে বেরোলাম একদল গায়ক। মনে পড়ে, এক দিনে প্রায় তিন হাজার টাকা আর রাশীকৃত কাপড়চোপড় আদায় করে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বন্যা রিলিফ ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়েছিলাম। ‘ভিক্ষা দাও গো পুরবাসী’- বন্যার জন্য অসহায় নরনারীর কল্পিত ছবি চোখের সামনে যেন ভেসে উঠত, তাই গাওয়ার সময় রোরুদ্যমান কণ্ঠের আবেদনে পেয়েছিলাম অভূতপূর্ব সাড়া।

বড় বড় সভায় গান গাওয়ার জন্য আসতে লাগল আমন্ত্রণ। ফরিদপুরের লাল মিঞার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কার্সিয়াংয়ে। সে ছাত্রদের নিয়ে ফরিদপুরে এক সভা করবে। পাকড়াও করল কাজীদা, কবি গোলাম মোস্তফা ও আমাকে। ফরিদপুরে এই ত্রয়ীর আগমনবার্তা ফরিদপুর জেলা ছড়িয়ে গিয়েছিল, ফলে সে সভ্যস্থল বিরাট এক মেলা- বাড়িতে পরিণত হয়েছিল। মাইকের প্রচলন হয়নি, কাজেই লোকে না পারল কাজীদার বক্তৃতা শুনতে, না পারল গোলাম মোস্তফার কবিতা শুনতে, না পারল আমার গান শুনতে। বাঙালির বৈশিষ্ট্য, সবাই বলছে, ‘চুপ করুন চুপ করুন’- চুপ আর কে করবে। আমাদের তিনজনকে দাওয়াত করেছিলেন অধ্যাপক হুমায়ুন কবীরের বাবা। বাড়ির গেটেই বড় বড় করে লেখা ‘বল বীর চির উন্নত মম শির’। কাজীদার সম্মানের জন্য বাড়িতে ঢোকার আগেই তাঁর বাণীটা বড়- আনন্দ জোগাল প্রাণে। কবীর সাহেবের বাবা অবসর গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্য দেখে মনে হলো না তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। আমাদের তিনজনের দু-তিনখানা ছবি তুললেন। আস্ত এক রোহিত মৎস্য ফ্রাই করে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রেখেছেন, কাঁটাচামচে রাখা আছে, মাছটা যেন সত্যিই জ্যন্ত, জ্বলজ্বল করে চেয়ে আছে। কাজীদা বললেন, ‘না বাবা, আমি প্রাণী হত্যা করতে পারব না।’ খুব হাসির হুল্লোড় বয়ে গেল।

কবীর সাহেবের বাড়িটা বহু দেশের সংস্কৃতিতে ভরা। ঘরের ভেতরে কোথাও রেখেছেন লাউগাছ পুঁতে, লতিয়ে লতিয়ে সেটা উঠেছে জানালা বেয়ে। কোনো ঘরের কোণে জাল দিয়ে রেখেছেন কতগুলো ছোট ছোট পাখি। আর সারাটা বাড়িতে খুব কম হলেও ২০০ হাসনাহেনার গাছ। এঘর-সেঘর দেখিয়ে কবীর সাহেব আমাকে চুপটি করে বললেন, ‘আপনি আমার সঙ্গে আসুন, একটা জিনিস দেখাচ্ছি, এটা আমার নিজস্ব, কাউকে দেখাই না, আপনাকেই শুধু দেখাতে চাই।’

অবাক হয়ে তাঁর পেছনে পেছনে গেলাম। তালা-চাবি দেওয়া একটা প্রকোষ্ঠ। দরজা খুলতেই ভেসে এল লোবান-ধুপধুনা-আতরের গন্ধ। স্বর্গীয় একটা সুবাসে অন্তর হলো ভরপুর। জানালা খুলে দিলেন। দেখলাম, তাজমহলের অনুকরণে ঘরের ভেতরেই আরেক তাজমহল- পাশে জায়নামাজ-তসবিহ। বললেন, ‘এ-ই আমার এবাদতখানা।’ বললাম, ‘কিন্তু এই সুন্দর তাজমহলের মানে?’ সে কথার কোনো জবাব দিলেন না তিনি, চোখ দুটো শুধু অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। আর বললেন, ‘দোয়া করবেন।’

হিলি স্টেশনের কাছে জয়পুরহাটের স্কুলের ছেলেরা একবার আমাকে দাওয়াত করে নিয়ে গেল। সন্ধ্যার পর বসল তাদের গানের আসর; কিন্তু একটি ছেলে বলল, দেখুন, এখানে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইলে একটা মস্ত বড় গণ্ডগোল হবে। কারণ, এখানে লা- মজহাবির সংখ্যাই বেশি। এরা গানবাজনা খুবই আপত্তিকর মনে করে।’ প্রথমটাই সত্যিই বড় দমে গেলাম। তা ছাড়া শিল্পীরা কোনো দিনও হুড়হাঙ্গামা সইতে পারে না। শান্ত পরিবেশ না হলে, চারধারে স্তব্ধ বিরাজ না করলে অসুরের শব্দে সুর পালিয়ে যায়। আমি স্টেজে ঢুকলাম। সভার সবার উদ্দেশ্যে সালাম জানিয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম। এক ভদ্রলোক আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি নাকি যন্ত্রসহকারে এখানে গান গাইবেন, কিছুতেই তা হবে না।’ আমি বললাম, ‘কে বলেছে গান গাইব? আমি গান গাইব না, কয়েকটা কথা বলব মাত্র। আচ্ছা, তেরো শ বছর আগে আরবদেশে যেদিন আমাদের প্রিয় নবী এই দুনিয়ায় নাজেল হলেন, তখন সারা প্রকৃতির অবস্থা কী হয়েছিল, তিনি এসে আমাদের জন্য কী বাণী প্রচার করলেন, শুনুন’, এই বলে সুরে সুরে গাইলাম—

“তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে

মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ ও দোলে।”

‘শুনতে চান এই জিনিস?’ সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ‘জি জি, বলুন।’ আমি ইশারা করলাম- সবাই বসুন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সভায় সবাই বসল এবং চারদিকে স্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল। এরপর গাইলাম, ‘সৈয়দে মক্কী মদনী’। তার পরই বিদায় নিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা, তাহলে আজ আসি।’ সভায় উঠল হট্টগোল, ‘না না, আমরা শুনতে চাই, আরও বলুন, আরও গান!’ আমি বললাম, ‘যদি শুনতেই চান’, পাশে ইশারা করে বললাম, ‘এই, হারমোনয়ামটা দাও।’ হারমোনিয়াম বাজিয়েই ধরলাম, বাজিছে দামামা বাঁধ রে আমামা।’ এরপর আরম্ভ করলাম বক্তৃতা। আচ্ছা, ‘মাংস রান্না করতে গিয়ে কী কী মসলা লাগে?’ কেউ বলবেন পেঁয়াজ, কেউ বলবেন রসুন; আমি বলি কি- আসল জিনিসই তো বাদ দিচ্ছেন- সব মসলাই দিলেন, কিন্তু লবণ তো দিলেন না!’ ইশারা করলাম, ‘স্টেজের ভেতরে নিয়ে এসো।’ এল তবলা নিয়ে তবলচি। গান ধরলাম, ‘আমার মুহাম্মদের নামের ধেয়ান হৃদয়ে যার রয়’।

এরপর গাইলাম—

‘জাগে না সে জোশ লয়ে আর মুসলমান।’

এরপর গান থামিয়ে বললাম, মুসলমান সমাজের গলদ কোথায়; অশিক্ষা-কুশিক্ষায় এমনিতেই সবাই ক্লীব হয়ে আছে- তার ওপর জগদ্দল পাথরের মতো এই সমাজের বুকে বসে আছে কাঠমোল্লার দল। এই পাথর সরিয়ে বেরিয়ে এসো তরুণ পথিক, হাঁক দাও নুতন সুরে নয়া জামানার নব-নকিব, ঘুচিয়ে দাও সরিয়ে দাও এই জঞ্জাল, জ্বালো জ্ঞানের মশাল!

জীবনে সেদিন পেলাম এক নতুন আস্বাদ। কারণ, গানের শেষে সভার প্রত্যেকটি লোক আমার সঙ্গে হাত মেলাল। কণ্ঠে তাদের আশার বাণী, চোখে তাদের ভবিষ্যতের আলো। সমাজে এ ধরনের কাজ গান দিয়েই কার্যকর হবে বেশি, বুঝলাম- তাই বাংলার মুসলমান সমাজে যেখান থেকে আসত আহ্বান, উপেক্ষা না করে শারীরিক শত কষ্টকে উপেক্ষা করেও ছুটতাম, সাড়া দিতাম তাদের আহ্বানে।

বোধ হয় এই জন্যই কবি গোলাম মোস্তফা কোনো এক সভায় আমার সম্পর্কে বলেছিলেন যে আব্বাস এ যুগের মডার্ন মৌলবি।

মোহামেডান স্পোর্টিং উপরি উপরি পাঁচ-ছয় বছর লিগ-বিজয়ী, শিল্ড-বিজয়ী। সারা বাংলার আকাশ-বাতাস তখন ‘মোহামেডান স্পোর্টিং জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে মুখরিত। এদের খেলায় জয়লাভের জন্য গ্রামে মুসলমানদের রোজা রাখতে দেখেছি। খেলা দেখার জন্য দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া থেকে দলে দলে মুসলমানেরা আসত। বাংলার মুসলমানদের জাগরণের মূলে মোহামেডান স্পোর্টিংয়ের খেলার অবদান যে কত বিরাট, ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকেরা নিশ্চয়ই সে কথা ভুলে যাবেন না। কবি গোলাম মোস্তফা এই ইতিহাসকে রূপ দিলেন গানের ভাষায়- ‘লিগ বিজয় না দিগ্বিজয়’। সে গান আমি রেকর্ড করলাম। বাংলার ঘরে ঘরে দিলাম রেকর্ডের মাধ্যমে মুসলমানের বিজয়-বারতা পৌঁছে।

রাজা-মহারাজা, আমির-ওমরাহ, নবাব-বাদশাহ্ এঁদের দরবারে সভা-গায়ক ছিল, এখনো কিছু কিছু আছে। সম্রাট আকবরের দরবারে তানসেন সভা-গায়ক ছিলেন, এ তো সবারই জানা কথা। কিছুদিন আগেও জয়পুর, যোধপুর, উদয়পুরের রাজা-মহারাজা সাইগলকে সভা-গায়ক রেখেছিলেন। একই গায়ক এতগুলো রাজ-রাজড়ার দরবারের গায়ক কী করে হন, এ প্রশ্ন মনে হওয়া স্বাভাবিক। জয়পুরের রাজা হয়তো গায়ককে সভা-গায়ক করে নিলেন বছরে দুই হাজার টাকা পারিশ্রমিক হিসেবে, বছরে এক- আধবার আসতে হয়। বরোদার গাইকোয়াড় শুনলেন, সাইগল জয়পুরের সভা-গায়ক, তিনি তাঁকে তলব করে বললেন, বছরে চার হাজার টাকা, একবার মাত্র দরবারে হাজির হতে হবে। এমনি করে শুনেছি সাইগলের ভাগ্যে বহু করদ-মিত্ররাজার দরবারে সভা- গায়কের সম্মান জুটেছিল।

আমি ভাবছি, রাজ-রাজড়ার সভা-গায়ক হওয়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমার হয়নি বটে, কিন্তু বাংলাদেশে এ জীবনে অন্তত পাঁচ হাজার সভায় যোগদান করার মহাসৌভাগ্য তো হয়েছিল। আর সেসব সভায় শ্রোতা ছিল দেশের আপামর জনসাধারণ। তাদের মাঝে গানে গানে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি দেশাত্মবোধ, আত্মসচেতনতা, বাঁচার অধিকার; জাগিয়ে দিয়েছি হারিয়ে যাওয়া পল্লির কথা, পল্লির গাথা, পল্লির সুর; তাদের অবচেতন মনে জিজ্ঞাসা জাগিয়ে দিয়েছি; বলেছি, উত্তিষ্ঠিত, জাগ্রত।

রাজসভায় থাকে বিশিষ্ট, সম্ভ্রান্ত, অভিজাত অতিথি আর আমার শ্রোতা গ্রামের করিমুদ্দি, ধলাই মিঞা, সর্বেশ্বর দাস, পেনকেটু বর্মণ। এরা যখন আমার গানে শুনেছে-

“ওঠ রে চাষী জগৎবাসী ধর কষে লাঙল

ও ভাই) আমরা ছিলাম পরম সুখী ছিলাম দেশের প্রাণ

তখন) গলায় গলায় গান ছিল ভাই গোলায় গোলায় ধান

আজ) কোথায় বা সে গান গেল ভাই কোথায় সে কৃষাণ

ও ভাই) মোদের রক্ত জল হয়ে আজ ভরতেছে বোতল।”

তখন তাদের চোখ হয়েছে অশ্রুসজল। কিন্তু হুঙ্কার দিয়ে আবার যখন গান ধরেছি-

“আজ) জাগ রে কৃষাণ সব তো গেছে কিসের বা তোর ভয়

এই) ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়,

ঐ) দিগ্বিজয়ী দস্যুরাজার হয়কে করব নয়

ওরে) দেখবে এবার সভ্যজগৎ চাষার কত বল।”

তখন এ গান শুনে পেনকেটু আর করিমুদ্দির হাতের মুঠোর তলে লাঠির বাঁট আবার মোচড় দিয়ে উঠেছে।

ছাত্রদের মিলাদের সভা, সরস্বতী পূজার জলসা, স্কুল-কলেজের চ্যারিটি শো, দাতব্য- চিকিৎসালয় স্থাপনের জন্য বিচিত্রানুষ্ঠান। এ ছাড়া হাজারো রকমের জনসমাগমে সারা দেশের সভায় সভা-গায়কের সম্মান পেয়েছি। সারা দেশের আবালবৃদ্ধবনিতার শুভেচ্ছা, প্রীতি কুড়িয়েছি। যশের আশায় নয়, তাদের মনে ক্ষণিকের জন্য দিতে পেরেছি আনন্দ, গানের ভেতর দিয়ে দুটো কাজের কথা বলার সুযোগ পেয়েছি বলেই নিজেকে ধন্য মনে করতাম।

বিদেশ ভ্রমণ : নানা দেশের বিচিত্র সব শহরে

ইংরেজি ১৯৫৫ সালে প্রথম দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংগীত সম্মেলনে যোগদান করার জন্য ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী ম্যানিলায় যাই। সেখানে ফারইস্ট ইউভিার্সিটি হলে ভারত পাকিস্তান চীন জাপান ইন্দোনেশিয়া, বার্মা প্রভৃতি দেশের সংগীতবিশারদদের তিন দিন ধরে (২৯-৩১ আগস্ট) ওই সব দেশের সংগীতের বিভিন্ন ধারা বা গতি নিয়ে আলোচনা সভা বসে। ইউনিভার্সিটির দালানকোঠা যে জায়গায় অবস্থিত, তার পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক শোভা প্রথমেই মনকে আকৃষ্ট করে। তিন দিকে দূরে দূরে পর্বতশ্রেণী, আরেক দিকে প্রায় পঁচিশ মাইল দূরে ম্যানিলা শহর- দিগন্তপ্রসারী মাঠ.... ইউনিভার্সিটির কোনো কোনো বিষয়ের বিল্ডিং একেকটা পাহাড়ের ওপর-অতি চমৎকার।

পূর্ব পাকিস্তানের গানের ধারা বা গতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গের ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি, সারি, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদি, কীর্তনের কথাই বলেছি। আমি প্রায় আধঘণ্টা ধরে পূর্ববাংলার পল্লিগীতি সম্বন্ধে বক্তৃতা দিয়েছি। বক্তৃতার মাঝে মাঝে প্রায় সাত-আটখানা গানও গেয়েছি। গানের বাণী ইতিপূর্বে ইংরেজিতে সবার কাছে অনুবাদ করে দেওয়া হয়েছিল। ভাটিয়ালি সুরের সঙ্গে সে দেশের লোকের পরিচিতি ঘটেনি কখনো, কিন্তু সংগীতের সভায় দেশ-বিদেশের সংগীতজ্ঞদের কাছে এ সুর ভালো লেগেছিল বোধ হয়, নইলে একেকটা গানের শেষে উচ্ছ্বসিত হাততালির স্থায়িত্ব এতক্ষণ ধরে হতো না।

অন্যান্য দেশ থেকে যেসব প্রতিনিধি এসেছিলেন, তাঁরা অধিকাংশই গ্রামোফোন রেকর্ড সহযোগে তাদের দেশের গানের ধারার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে।

ম্যানিলার এক প্রকাণ্ড অপেরা হলে একদিন আমাদের সংগীতের জলসা বসে। লায়লা আর্জুমান্দ বানু একখানা রবীন্দ্রসংগীত, দুখানা নজরুলগীতি এবং একখানা পল্লিগীতি পরিবেশন করেন। গায়িকার কণ্ঠমাধুর্যে সে দেশের গুণীজন অপরিসীম আনন্দ অনুভব করেন- প্রতিটি গানের শেষে করতালি দিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। গানের সঙ্গে তবলা সংগত করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট তবলাবাদক মোহম্মদ হোসেন। আমিও চার-পাঁচখানা পল্লিগীতি পরিবেশন করি। গানের শেষে বহু নরনারী আমাদের সঙ্গে পরিচিত হতে এলেন। তবলা বাজনা তাঁদের খুবই মুগ্ধ করেছিল। আমি ভারত থেকে আগত প্রফেসর দেওধরের সঙ্গে হারমোনিয়াম সংগত করি। এক ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, ‘তোমাদের দেশের গান এত চমৎকার, এমন চিত্তাকর্ষক যে আমি আমার স্বামীর সঙ্গ পরিহার করে দূরের আসন থেকে একদম স্টেজের সামনে এসে বসেছি।’ তবলা কী করে শেখা যায়, এই নিয়ে খানিকক্ষণ খুব ঔৎসুক্য সহকারে অনেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন।

ফিলিপাইনের সে সময়কার যুবক প্রেসিডেন্ট ম্যাগসেসের বাসায় বিভিন্ন দেশের সংগীতজ্ঞদের সম্মানের জন্য চায়ের নিমন্ত্রণে গেলাম। বাড়িটি চকৎকার। বিশ্বসুন্দরী নামে পরিচিতা ফিলিপাইনের এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে আলাপ হলো। একটি পনেরো-ষোলো বছরের মেয়ে এমন সুরেলা হাতে বেহালা বাজাল যে সুরে সুরে স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে পড়লাম।

মিস কাসিলাগের মিউজিক একাডেমিতে একদিন চায়ের দাওয়াত ছিল। একাডেমিটি সত্যি চমৎকার। সাইন্ড প্রুফ ছোট ছোট একেকটা প্রকোষ্ঠ। সেই সব ঘরে একেকটি ছাত্র বা ছাত্রী প্রাণভরে চিৎকার করে গলা সাধে। পাশের ঘর থেকে একবিন্দু শব্দ ভেসে আসে না।

ম্যানিলা ছেড়ে এলাম হংকং। এমন সুন্দর শহর আর কোনো দিন দেখিনি। খান সাহেব তাজুদ্দিন এখানকার বড় ব্যবসায়ী। তাঁরই সৌজন্যে শহরের সব দর্শনীয় জায়গা দেখা হলো।

এই সুন্দর শহর ছেড়ে আমরা একদিন উড়লাম ব্যাংককের পথে। পোখরাজ, চুনি, পান্না- এগুলো এখানকার প্রসিদ্ধ জিনিস। এসব পাথর যে এ দেশে এত সস্তা, সে কথা ভাবতেও পারিনি।

এলাম রেঙ্গুন। রাকৃষ্ণ মিশন হলে আমাদের উপলক্ষ করে ব্রহ্মপ্রবাসী বাঙালি হিন্দু- মুসলমান একটি সংগীত জলসার আয়োজন করেছিল। মিশন হলটির নিচের প্রকোষ্ঠে প্রকাণ্ড লাইব্রেরি- এখানে বাঙালিরা বিকেলে পড়াশোনার জন্য ভিড় জমায়। দ্বিতল প্রকোষ্ঠে বিরাটায়তন হল। সেখানে সংগীত জলসা বসল সন্ধ্যায়। হলে তিলধারনের স্থান নেই। রাত দশটা অবধি রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক, পল্লিগীতি এবং গজল লায়লা, রেঙ্গুনের কয়েকজন শিল্পী এবং আমি পরিবেশন করলাম। রেঙ্গুন থেকে সোজা ফিরে এলাম ঢাকায়।

আন্তর্জাতিক লোকসংগীত কাউন্সিলের ১৯৫৬ সালের অধিবেশনে সুরশিল্পী হিসেবে যোগদান করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আমি কবি-সাহিত্যিক বা বক্তা নই। গান গেয়ে চলেছি আজীবন। আমার কথা বলি সুরে সুরে। গদ্য বা পদ্য লিখে বলতে গেলে কথার খেই হারিয়ে ফেলি, বলার ছন্দপতন হয়। এ কৈফিয়ত দিচ্ছি এই জন্য যে আমাকে পল্লিসংগীতের অধিবেশনে গভর্নমেন্ট পাঠাবে, এ খবরটা যখন একটু জানাজানি হয়েছিল, তখন এক বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘এসব পণ্ডিতের আসরে তুমি মূর্খ মানুষ গিয়ে দেশের বদনামই করে আসবে।’ বন্ধুর এই সাবধানবাণী প্রতিনিয়ত আমার মনে জাগরূক ছিল। অতি ভীরু পায়ে সংগীত সম্মেলনে প্রবেশ করেছি, অতি বিনয়ে আমার দেশের পল্লিসংগীতের অবস্থা বর্ণনা করেছি; ফলে লাভ হয়েছে এই যে আমার দেশের ফলভারাবনত বৃক্ষের দিকে চেয়ে পাশ্চাত্যের মনীষীরা আমার দেশের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাই করেছেন। বিশ্বের দরবারে পূর্ব পাকিস্তানের পল্লিসংগীত যে সর্বশ্রেষ্ঠ আসন দখল করে আছে, তা আমার গানে- ভাবে- সুরে কিছুটা প্রমাণ করে দিতে পেরেছি। বহু পণ্ডিত অংক দিয়ে যা প্রমাণ করতে পারেননি, পল্লিমায়ের সেই মেঠো সুরের আসনখানি পথের ধারে না পেতে বিশ্বসভায় পেতে ধরেছিলাম এবং যাওয়ার আগে আমার কল্যাণকামী বন্ধুবান্ধবের শুভ কামনায়, সর্বোপরি পরম করুণাময় খোদাতাআলার অসীম অনুকম্পায় আমার দেশের মর্যাদা বহাল রেখে ফিরেছি।

১৯৫৬ সালের ১৭ জুলাই। তেজগাঁও বিমানঘাঁটি থেকে অ্যারোপ্লেন উড়ল করাচি অভিমুখে। দু'দিন সেখানে থেমে ১৯ জুলাই রওনা দিলাম বৈরত অভিমুখে। ২০ জুলাই খুব ভোরে এক জায়গায় প্লেনখানা মাটিতে নামল। বলে দেওয়া হলো, ‘আপনারা নেমে যান, টিফিন করে আসুন।’ এয়ারপোর্টের ঘরে গিয়ে জানতে পারলাম, আমরা বাগদাদে নেমেছি। সম্ভ্রমে দুই মিনিট চোখ বুজে হযরত বড়পীর সাহেবের উদ্দেশ্যে দোয়া-দরূদ পড়লাম। হোটেলের বয়-বাবুর্চিদের পোশাক লক্ষ্য করলাম- আরবি পোশাক। টেবিলে চা-কফি এনে দিল, সঙ্গে দিল অন্তত দু'শ আঙুর। প্রাণভরে আঙুরই খেলাম- চা-কফি পড়েই রইল। প্লেন মাত্র এক ঘণ্টা বিরাম। ইচ্ছা হচ্ছিল হযরত বড়পীর সাহেবের পবিত্র মাজার জিয়ারত করে আসি, কিন্তু উপায় নেই। হঠাৎ এক ভদ্রলোক আামর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘ফ্লেন খখন ছাড়ব ইয়ারে।’ মহা বিস্ময়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। পরে জানতে পারলাম, সিলেট থেকে তিনি বিলাত রওনা হয়েছেন। সেখানে তাঁর ভাই হোটেলে কাজ করেন। তিনিও চলেছেন সে দেশে ভাগ্যান্বেষণে।

ইংরেজি লেখাপড়া এবিসিও জানেন না। যা হোক, প্রাণ খুলে তাঁর সঙ্গে বাংলা বললাম। জানি না, কত দিন এ ভাষায় আর কথা বলতে পারব না। প্লেন উড়ল। তখনো সূর্য ওঠেনি। আমার ঘড়িতে ঢাকার টাইম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছি, ঢাকা টাইম ৮টা ১০ মিনিট।

প্লেনখানা উড়ছে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখছি বাগদাদের বড় বড় মসজিদের চূড়া, ঘরবাড়ি... ক্রমে ক্রমে সে দৃশ্য সরে গেল। তারপর শুধু ধূ ধূ মরুভূমি। মাঝে মাঝে তরুলতাবর্জিত ধূসর পাহাড়শ্রেণী। আরবদেশ। কত ইতিহাসের পাতাই না অ্যারোপ্লেনের দ্রুতগতির সঙ্গে উল্টে যাচ্ছিল, কারবালা প্রান্তরের মর্মভেদী ইতিহাস- হযরতের ওপর কোরেশদের অত্যাচার- ইসলামের প্রথম রবি এই আরব আকাশেই দেদীপ্যমান হয়ে সারা পৃথিবীতে আলো বিকিরণ করেছিল। এবার প্লেন যখন ভূমি স্পর্শ করল, শুনলাম আমার গন্তব্যস্থল বৈরুতে এসে পড়েছি।

সমুদ্রের বিরাট বিরাট ঢেউ বৈরুত শহরের পাহাড়ের গায়ে আছড়ে আছড়ে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে, সে জায়গায় সৃষ্টি হচ্ছে সফেদ ফেনার শ্বেত উত্তরীয়। এয়ারপোর্টের দৃশ্যই এত মুগ্ধ করে তুলল যে মনে হচ্ছিল এখানেই বসে থাকি। ট্যাক্সি ভাড়া করে শহরের দিকে চললাম। রাস্তার দুই ধারে কমলালেবুর গাছ- পাইনগাছের সারি। ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে গল্প করছি। যেইমাত্র আমার পরিচয় পেয়ে বুঝতে পারল আমি মুসলমান, অমনি সে আস্সালামু আলাইকুম বলে দুই হাত ধরে মোসাফা করল। ট্যাক্সির হাতল ছেড়ে সে যেভাবে আমার হাত মোসাফা করার জন্য ঔৎসুক্যে হাত চেপে ধরে রইল, তাতে আমি তো দস্তরমতো ভড়কে গেলাম। প্রায় আধ মিনিট সে আমার হাত চেপে ধরেই রইল- ওদিকে বল্লাহীন অশ্বের মতো মোটর ছুটে চলেছে। যা হোক, সে বলল, ‘আমি খোদ্রা, তুমি সৈয়দ- আমি খোদ্রা তুমি সৈয়দ, তাই না?’ আমি বললাম, ‘ধরে নাও তা-ই।’

ব্রিস্টল হোটেলে নিয়ে এল আমাকে। বিরাট হোটেল এবং চমৎকার পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি।

হোটেলের বয়গুলোর চেহারা কী সুন্দর! কিন্তু কথা বলতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। সামান্য দু-একটা ইয়েস, নো, ভেরি গুড ছাড়া ইংরেজি বলতে পারে না। আরবি কথা বলে। অগত্যা হোটেলের রিসেপশন ইনচার্জের সঙ্গে ইংরেজিতে আলাপ জমাই।

বিকেলে শহর দেখতে বের হলাম। কিন্তু বিরাট শহর দু-এক দিনে কতটুকুই বা দেখা যাবে। পাহাড়ের ওপরে, নিচে, সমতল ভূমিতে ছড়িয়ে আছে শহরের দর্শনীয় কত কী-

ট্রাম লাইনগুলো সমতল ভূমিতে চলতে চলতে হয়তো হাজার ফুট নিচে নেমে গেল একদম সমুদ্রসৈকতের বেলাভূমিতে, আবার উঠে গেল পাহাড়ের অভ্রভেদী চূড়ায়। একেকটা বিরাট মনিহারি দোকানের পাশেই আলু, পেঁয়াজ, তরিতরকারির দোকান। এ জিনিস প্রথম এখানেই নজরে পড়ল। আমাদের দেশে যেমন মাছ, তরিতরকারির আলাদা বাজার- এই বৈরুতে থেকে সারা ইউরোপ ভূখণ্ডে আরম্ভ হলো তার ব্যতিক্রম। যেখানে খুশি সেখান থেকে দৈনন্দিন বাজার করা চলে। অর্থাৎ পথ চলতে চলতে কিছু দূর পরে পরে বড় বড় দোকানের পাশেই মাছ, মাংস, তরিতরকারির দোকান সাজানো রয়েছে।

এখানকার লোক শতকরা ৫০ ভাগ খ্রিস্টান আর বাকি ৫০ ভাগ মুসলমান। মুসলমানি লেবাস পরা বা এমনকি দাড়ি-গোঁফওয়ালা একটি লোকও নজরে পড়ল না। মেয়েরা সবাই গাউন পরা। আরবিই এ দেশের ভাষা।

২১ জুলাই সকাল আটটায় ব্রিস্টল হোটেল থেকে বৈরুত এয়ারপোর্ট রওনা হলাম। মাত্র একদিন এখানে অবস্থানের জন্য মনে বড় আক্ষেপ হলো।

বেলা দেড়টায় রোমে পৌঁছালাম। ইনফরমেশন অফিসে খোঁজ নিয়ে যা শুনলাম, তাতে তো হতাশ হয়ে পড়লাম। রোমের সমস্ত হোটেল আগন্তুকে ভর্তি। কোথাও কোনো হোটেলে ঠাঁই নেই। অফিসার ভদ্রলোক প্রায় পনেরো মিনিট বহু হোটেলে ফোন করে শেষ পর্যন্ত একটা হোটেলে সিট পাওয়া যাবে বলে আমাকে হোটেলের ঠিকানা দিয়ে নিজেই ট্যাক্সি ডেকে ড্রাইভারকে সব বুঝিয়ে দিলেন। হোটেলে এলাম- নাম হোটেল সপ্লেনযার।

বিকেলে বেড়াতে যাব, কিন্তু সারা শরীরে নেমে এসেছে অবসাদ। একটু শুয়ে পড়লাম। ঘুম এল। রাত দশটায় ঘুম ভেঙে গেল, বুঝতে পারলাম বেশ জ্বর এসেছে। মনটা খুব দমে গেল।

২২ জুলাই সকালে সামান্য নাস্তা করে ঘরে এলাম। শরীরটা খুব দুর্বল। কিন্তু মনে হলো, ঘরে বসে থাকলে শরীর সত্যিই ভেঙে পড়বে; তাই হোটেলের রিসেপশন রুমে এলাম। এখানে রোমের দর্শনীয় জায়গায় ভ্রমণকারীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য আধা ঘণ্টার মধ্যেই বাস আসবে, জানতে পারলাম। এই বাসে সমস্ত দর্শনীয় জায়গা দেখানো হয়। আমাদের বাস যেখান থেকে রওনা হলো, সে জায়গাটা রোমের এক বিখ্যাত স্থান। প্রকাণ্ড একটা পার্কের তিন ধারে বিরাট বিরাট ইমারত। সেই ইমারতের শীর্ষে খুব বড় বড় সম্রাট, সেনানীর প্রস্তরমূর্তি।

বাস রওনা হলো রোম শহর থেকে ট্রিবলি শহরের দিকে প্রায় কুড়ি মাইল দূরে। কী চমৎকার রাস্তা! রাস্তার দুই ধারে গমক্ষেত থেকে গম কেটে নেওয়া হয়েছে- গমের পাশ দিয়ে ফুটে রয়েছে পপি ফুল। প্রায় আঠারো মাইল এসে মোটর এক জায়গায় থামল। সেখানে যাত্রীদের নামতে বলা হলো। গাইড আামদের নিয়ে চলল রোম শহর গড়ে ওঠার বহু বহু শতাব্দী আগের এক রাজবাড়িতে। বাড়িঘর ধ্বংস হলেও এখনো স্থাপত্যশিল্পের অপূর্ব দক্ষতার স্বাক্ষর নিয়ে সে প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। রাজপ্রাসাদে একটা পুকুরের পাড়ে নিয়ে আসা হলো আমাদের। গাইড পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে একটা রুটির টুকরো ছুড়ে দিল, অমনি শত শত হাঁস সেই রুটির লোভে কাছে এসে পানির ভেতর থেকেই সেই সব রুটির টুকরো খেতে লাগল। মনে পড়ল, সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজারের পুকুরে গজার মাছের কথা। সেখান থেকে বিরাট উদ্যানে গেলাম। রাস্তার দুই ধারে পাইনগাছের সারি এমন সুন্দরভাবে লাগিয়েছে, মনে হচ্ছিল এ পথ যেন আর না ফুরায়। সত্যি ইত্যালির সমস্ত রাস্তার দুই ধারে গাছপালা এমন অভিনব পদ্ধতিতে লাগানো যে অন্য কোনো শহরেই তা চোখে পড়েনি। আবার মোটরে উঠলাম।

পাহাড়ের গা বেয়ে মোটর বাস উঠছে। মনে হচ্ছিল দার্জিলিং-কার্সিয়াংগামী পথের কথা।

ট্রিবলিতে এসে মোটর থামল। ছোট্ট শহর। এখানে কী এমন দর্শনীয় থাকতে পারে, ভাবতেই পারিনি। আমাদের গাইড আমদের এবার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে পাহাড়ের অনেকখানি নিচুতে নিয়ে আসছেন। একটা বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সবাইকে থামালেন। দাঁড়িয়ে পড়লাম- ব্যাপার কী? তিনি বললেন, ‘Beware of pickpockets, beause they are international’। আর বলতে হলো না, সবাই হাসিতে ফেটে পড়লাম।

কল্পনাতীত কাব্যরাজ্যে এসেছি। পাহাড়ের ওপর থেকে হাজার হাজার ঝরনার মালা একটা স্বপ্নময় ঝরনাপুরীর সৃষ্টি করেছে। ঝরনার পানিতে সৃষ্টি করেছে একটা কৃত্রিম গোল হ্রদ। সেই হ্রদ। সেই হ্রদের মাঝ থেকে ঊর্ধ্বমুখে উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে শত শত ঝরনার পানি। তরুণ-তরুণীর মেলা বসেছে সেখানে। প্রত্যেকের কাঁধে একটা করে ক্যামেরা ঝোলানো। পাহাড়ের একটা অংশ কী চমৎকারভাবে, অদ্ভুতভাবে, ভয়াবহভাবে হ্রদের মাঝপথে ঝুলে রয়েছে! কৌতূহলী যুবক-যুবতীরা সেই পাহাড়ের গুহার মতো জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে- তাদের সামনে পড়ছে বৃষ্টিধারার মতো ওপর থেকে ঝরনার জল। ওপর থেকে নামছে ঝরনা, ডানে-বাঁয়ে যেদিকে তাকাই, হাজার হাজার ঝরণা। সেই জলপ্রপাতের শব্দে সেখানে ধ্বনিত হচ্ছে এক অপরূপ সুর। কোথাও ব্রাঞ্জো বাজিয়ে কোনো তরুণ তার তরুণীর উদ্দেশ্যে গান ধরেছে, কোথাও কেউ ফটো তুলছে। প্রায় দু’টি ঘণ্টা সেখানে ছিলাম- এর বাইরে যে দুনিয়া আছে, ভুলেই গিয়েছিলাম। গাইডের কথাই ঠিক। পকেট তো দূরের কথা নিজেকেই যে সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। শুনলাম, প্রায় সাত শ বছর আগে এই ঝরনার দেশ তৈরি হয়েছিল। অন্য পথ দিয়ে আমরা ওপরে উঠতে আরম্ভ করলাম। সে পথের দুই ধারেও পাঁচ-ছয় হাত পর পর ঝরনা। ঝরনার কাছ থেকে বিদায় নিলাম বটে, কিন্তু তার কলতান আজও স্মৃতির মণিকোঠা থেকে বিদায় নেয়নি।

রাতে এর দৃশ্য আরও অপূর্ব। খুব বড় বড় বিজলি বাতির ফ্লাডলাইটে একেকটা ঝরনার ওপর একেক রঙে আলো ফেলা হয়। সে দৃশ্য চোখে না দেখলে ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব।

২৩ জুলাই, বেলা সাড়ে এগারোটায় রোম থেকে প্লেনখানা ছাড়ল। জুরিখ পৌঁছালাম আড়াইটায়। জুরিখ দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। সৌন্দর্যের লীলানিকেতন এই সুইজারল্যান্ড। শুধু সবুজ- সবুজের মেলা, আর ফুল। প্রতিটি বাড়িঘরে মায় ছাদে পর্যন্ত ফুলের টবে ফুল ফুটিয়েছে। উঠেছি হোটেল সিগারটেনউ। ঠিক হ্রদের ওপরই হোটেলটি। হ্রদের অপর পারে দিগন্তবিস্তৃত পর্বতশ্রেণী- ঢেউ খেলিয়ে আকাশের প্রান্তদেশে নীলের কোলে মিশে গেছে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে হংকং- দার্জিলিংয়ের মতো অসংখ্য বাড়ি। হ্রদের এপারে বড় বড় দালানকোঠা, কিন্তু সব দালানের ছাদগুলো টালি দিয়ে ছাওয়া আর প্রতিটি বাড়িতে ফায়ার প্লেসের জন্য চিমনি।

যৌবনে দার্জিলিং দেখে মনে করেছিলাম, এর ওপর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বোধহয় দুনিয়ায় আর কোথাও নেই। ১৯৫৫ সালে হংকং দেখে দার্জিলিং ম্লান হয়ে গিয়েছিল। রোম দেখে স্তব্ধ বিস্ময়ে মানুষের বিরাট শিল্পেৎকর্ষের কথা ভেবে মূক হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু সুইজারল্যান্ড এসে মনে হচ্ছে, খোদা তাঁর বিরাট বিশাল দুনিয়া সৃষ্টি করার পর এই সুইজারল্যান্ড তাঁর অমর তুলির শেষ আঁচড়টা একটু অকৃপণ হাতেই দিয়েছিলেন। স্নিগ্ধ শ্যামল পাহাড়, ফল-পুষ্প-শোভিত মাঠঘাট, জুরিখ শহরের দুই পাশে স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠা স্বচ্ছ হ্রদ। সেই হ্রদে কত হাঁস, বিচিত্র ধরনের পাখি ভেসে বেড়াচ্ছে! শত শত নৌকায় তরুণ-তরুণীরা অবাধে ভ্রমণ করছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সুইমিং ক্লাব, তার পাশেই রাস্তায় রেস্তোরাঁ। রাস্তার ওপর চেয়ার পেতে খানাপিনা চলছে। পাশে তাকিয়ে দেখুন- বহুদূর বিস্তৃত আলু-কপির ক্ষেত। প্রকৃতিকে কীভাবে ধরে রেখেছে শহরের বুকেও।

সন্ধ্যার কিছু পরই হোটেলে খাওয়াদাওয়া শেষ করলাম। যদিও বেশ শীত, তবু মনে হলো হ্রদের পাড়ে একটু বেড়িয়ে আসি। পথঘাট জনমানবশূন্য হবে মনে করেছিলাম, কিন্তু তা নয়। কারণ এই মাসটাই তো ও দেশে গ্রীষ্মকাল অর্থাৎ আমাদের দেশের নভেম্বরের শীত। হ্রদের পাড় গুলজার হয়ে আছে লোকের আনাগোনায়। পাহাড়ের গায়ে ফুটেছে লক্ষ লক্ষ বিজলি বাতি। হ্রদের স্নিগ্ধ-শান্ত পানিতে পড়েছে সেই কোটি কোটি আলো- রাতের জুরিখ কী কাব্যময়!

২৪ জুলাই ভোর পাঁচটায় উঠে নামাজ পড়ে খোদার কাছে অসীম কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম, তাঁর সৃষ্টির নব নব সৌন্দর্যসম্ভার আমার চোখের সামনে প্রতিভাত করার জন্য। সকাল নয়টায় জুরিখ থেকে প্লেন ছাড়ল। নয়টা ৩৫ মিনিটে স্টুটগার্ট এয়ারপোর্টে নামলাম। এত অল্প সময়ে যে জার্মানি এসে পৌঁছাব, এ ধারণাও করতে পারিনি। অ্যারোপ্লেন থেকে নেমেই দেখি, এয়ারপোর্টে আমার বড় ছেলে মোস্তাফা কামাল আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে সেখানে দেখতে পেয়ে আনন্দে প্রাণ নেচে উঠল। কাস্টমসের চৌহদ্দি পেরিয়ে যখন বাইরে এলাম, পিতা-পুত্রের সেই মিলন- মুহূর্তে অন্তর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এল অনন্ত করুণাময়ের উদ্দেশ্যে কোটি কোটি শুকরিয়া।

স্বাস্থ্যবতী আঠারো-উনিশ বছরের একটি মেয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে আমাদের লক্ষ করছিল। পাশে এসে অভিবাদন করে ইংরেজিতে বলল, ‘স্টুটগার্ট যাবে- ট্যাক্সি চাই?’ আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ, দরকারই তো।’ মেয়েটি অদৃশ্য হয়ে গেল। দুই মিনিটের মধ্যেই সুন্দর একখানা প্রাইভেট গাড়ি নিজেই চালিয়ে নিয়ে এসে বলল, ‘উঠে পড়ো।’ অবাক হয়ে গেলাম। গাড়িতে উঠলাম- উঁচু-নিচু পথ। পিচঢালা। দুই ধারে অফুরন্ত ফসল। দূরে পাহাড়- ঝাউগাছের সারি চলে গেছে দূর হতে দূরান্তরে। খুব জোরে মোটর চালাচ্ছে মেয়েটি। আমি বললাম, ‘একটু আস্তে চালাও।’ মেয়েটি হেসে বলল, ‘কেন?’ আমি বললাম, ‘পথের দৃশ্য বড় সুন্দর- তাড়াতাড়ি পথ ফুরিয়ে গেলে তো এ দৃশ্য ভালো করে উপভোগ করতে পারব না।’ মেয়েটি আস্তে গাড়ি চালাতে লাগল। আমি বললাম, ‘দেখো, আমি সুইজারল্যান্ড থেকে আসছি। প্রকৃতির লীলানিকেতন সুইজারল্যান্ড, কিন্তু তোমার এ দেশও দেখছি সুইজারল্যান্ডের চেয়ে কম নয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। মনে হচ্ছে, সুইজারল্যান্ড আর জার্মানি- এরা দুই যমজ বোন।’ মেয়েটি খুব খুশি হয়ে বলল, তোমার অনুমান মিথ্যা নয়, আমার দেশের প্রশংসা করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।’

স্টুটগার্ট- ভেবেছিলাম ছোট শহর হবে, কিন্তু বিমানঘাঁটি থেকে ট্যাক্সি করে রেলওয়ে স্টেশনে যাওয়ার সময় উঁচু পাহাড় থেকে নগরীর যা চেহারা দেখলাম, তাতে রীতিমতো ভড়কে গেলাম। এ তো বিরাট নগরী! লোকসংখ্যা প্রায় ছয় লক্ষ। এ শহর সবচেয়ে বিখ্যাত ছাপাখানা ও পুস্তক প্রকাশনার জন্য। সারা জার্মানির প্রকাশনা ব্যবসা এই শহরে এসে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। যন্ত্রপাতি, কলকারখানার প্রায় ৯০ ভাগই গেল যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। দশ বছরের ভেতরেই কর্মঠ জার্মান জাতি আবার গড়ে তুলেছে এই বিরাট নগরী। ট্রাম, বাস, বিরাট বিরাট দালানকোঠা, বিমানঘাঁটি, কলকারখানা, দোকানপাট- কে বলবে এই শহর গেল যুদ্ধে ধ্বংস হয়েছিল! আমার মনে হলো, যে জাতি দশ বছরের ভেতরেই এমন অসাধ্য সাধন করতে পারে, তার স্বাধীনতা ঠেকিয়ে রাখে, এমন শক্তি পৃথিবীতে নেই।

স্টুটগার্ট স্টেশন- বিরাট আয়তন। লেফট লাগেজে আমার স্যুটকেস জমা দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে এক রেস্টুরেন্টে চা খেতে বসলাম। এই লেফট লাগেজ কথাটা আমাদের দেশের অভিধানে নেই। পশ্চিমে সমস্ত রেলওয়ে স্টেশনে নিজ নিজ স্যুটকেস, ব্যাগ ইত্যাদি জমা দেওয়ার একটা ঘর থাকে। নামমাত্র দুই-চার আনা একেকটা স্যুটকেসের জন্য দিয়ে একটা রসিদ নিয়ে আপনি সারা শহর দেখে বেড়ান- তারপর যখন খুশি এসে রসিদটা দেখালেই আপনার মাল দিয়ে দেওয়া হবে। শহর দেখার জন্য স্যুটকেস হাতে করে বেড়াতে হবে না, যাক, কয়েক ঘণ্টা সেখানে থেকে দুপুরের খাওয়া সেরে নেওয়ার পর ট্রেনে উঠলাম আমি আর আমার ছেলে। কী সুন্দর এখানকার ট্রেন! এতটুকু ঝাঁকুনি নেই, রেলওয়ে স্টেশনে নেই এতটুকু হট্টগোল, নেই পান-বিড়ি-সিগ্রেট-চাগ্রম-এর বাজখাঁই আওয়াজ, নেই কুলির ফ্যাসাদ। স্বল্প মাল নিয়ে ইউরোপের লোকেরা ভ্রমণ করে। আমাদের মতো বোঁচকা-কুঁচকি, হোেন্ডল, খাট-পালং, খাটিয়া নিয়ে এরা ট্রেনে ওঠে না। চমৎকার বসার ব্যবস্থা। উঁচু-নিচু পাহাড়ের বুক চিরে রৌদ্রস্নাত দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির ওপর দিয়ে চলল আমাদের ট্রেন।

ট্রেন চলেছে শহর ছাড়িয়ে গ্রামের পথে। কিন্তু গ্রাম বা লোকালয় নজরে পড়ছে, না। দুই ধারে দিগন্তবিস্তৃত শস্যাশ্যামল প্রান্তর। লেটুস, গম, যব, ফুলকপি, পালংশাকের ক্ষেত। সেই সব ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে পিচঢালা পথ। সেই পথের দুই ধারে বিরাট

ইলেকট্রিকের পোস্ট। সারা ইউরোপ ভূখণ্ডের সুদূরতম পল্লি অঞ্চলেও ইলেকট্রিকের বন্দোবস্ত। দুই ঘণ্টা পরে এসে পৌঁছালাম রটওয়েল নামের এক ছোট্ট স্টেশনে। রটওয়েলের অবস্থান হলো জার্মানির দক্ষিণে ব্ল্যাক ফরেস্টের ধার ঘেঁষে। এখান থেকে প্যারিস ট্রেনে মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের পথ।

স্টেশন থেকে নেমে খুব কাছেই গেলাম এক হোটেলে। কিন্তু এক মুশকিল হলো, হোটেলের মেয়ে-পরিচারিকা আর মেইড, কেউই ইংরেজি বোঝে না। নানা আকারে- ইঙ্গিতে শেষ পর্যন্ত বোঝানো গেল যে আমরা একটা রাতের জন্য তাদের অতিথি হয়ে থাকতে চাই। খাওয়াদাওয়া তাদের এখানে করব- শূকর আর মদজাতীয় সবকিছু আমাদের জন্য হারাম।

সেখানেই লক্ষ করলাম জার্মান কত ভদ্র আর অমায়িক। হোটেল পরিচারিকা আমাদের কথা বুঝতে পারছে না, তবু তার ক্লান্তি নেই। বারবার নানাভাবে আমাদের কথা বুঝতে ও তার কথা বোঝানোর অক্লান্ত চেষ্টা করে চলেছে সে। শেষ পর্যন্ত এক ইঙ্গ-জার্মান ডিকশনারি বের করল ভদ্রমহিলা। অনেক দরকারি কথা সেই অভিধানের সাহায্যে তাকে বোঝানো গেল। হোটেলে এক কোণে বসে একটি সুন্দর যুবক আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল। ভদ্রমহিলা ও আমাদের এই সংকটাপন্ন অবস্থা দেখে যুবকটি এগিয়ে এসে সুন্দর হাসি হেসে ইংরেজিতে বলে উঠল, ‘আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারি?’ কী কী খাবার লাগবে ভদ্রমহিলার কাছে ফরমাশ দিয়ে যুবকটি আবার হেসে বলল, ‘আমি না থাকলে তো আজ উপোস করে থাকতে হতো আপনাদের।’ বহু ধন্যবাদ জানালাম তাঁকে এই সাহায্য করার জন্য।

রটওয়েল মাঝারি গোছের একটা শহর। কিন্তু কী নেই সেখানে? ঘরে ঘরে বৈদ্যুতিক বাতি, আধুনিক জীবনযাত্রার সব উপকরণ সেখানে রয়েছে। আমাদের দেশের গ্রাম আর এ দেশের গ্রামের তফাত এত বেশি যে এ সম্পর্কে কিছু না বলাই ভালো। শুধু এটুকু বলতে চাই যে আমার দেশের প্রতিটি লোক দলাদলি আর রাজনৈতিক কাদা-ছোড়াছুড়ি ত্যাগ করে একমনে যদি অন্তত দশটা বছর একটানা পরিশ্রম না করে, তাহলে এ দেশের সমকক্ষ হওয়া তো দূরের কথা, এ দেশের কাছাকাছিও আমরা আসতে পারব না।

২৫ জুলাই- রাতটা রটওয়েলের সেই নির্জন পরিচ্ছন্ন হোটেলে কাটিয়ে সকাল দশটায় ট্যাক্সি করে এলাম ট্রসিংগেনে। ট্যাক্সি চালিয়ে এল মাঝবয়সী বেঁটেসেটে এক জার্মান মহিলা। কল্পনা করতে পারি, আমরা আমাদের দেশে এ অবস্থা! আমার মনে পড়ে গেল কাজীদার গান-

‘আঁধার হেরেমে বন্দিনী হল সহসা আলোর মেয়ে

সেই দিন হতে ইসলাম গেল গ্লানির কালিতে ছেয়ে

লক্ষ খালেদা আসিবে যদি এ নারীরা মুক্তি পায়।’

এখানে আমাদের দু’জনের জন্য দুটো আলাদা রুম আগেই রিজার্ভ হয়েছিল হোটেল রোজে। কিন্তু এখানেও একই সমস্যা, মেইড, পরিচারিকা, ওয়েট্রেস- কেউই ইংরেজি বোঝে না। খাওয়াদাওয়াটা নিয়ে আমার ভাবনা ছিল বেশি, কিন্তু না, এরা আমাদের পছন্দ-অপছন্দটা বুঝেছে। দুই বেলা পোয়াটাক রুটি-গোশত দিচ্ছে; সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ আলুভাজা, লেটুসপাতা, টমেটো, লেবু ও শসা।

খাওয়াদাওয়া করে শহরটা দেখতে বের হলাম। ট্রসিংগেনকে অবশ্য এরা গ্রামই বলে।

আমি ট্রসিংগেনকে না বলব শহর, না বলব গ্রাম। অথচ কেন যে একে শহর বলব না, তাও ভেবে পাচ্ছি না। ঘরে-ঘরে বৈদ্যুতিক বাতি, ঝকঝকে-তকতকে পিচঢালা রাস্তা- এতটুকু কোথাও কিছু পড়ে নেই। সর্বাধুনিক সাজে সজ্জিত একেকটা দোকানপাট; বড় বড় ছাপাখানা, সুন্দর সুন্দর বাড়ি। আশ্চর্য, একটা কুঁড়েঘর কোথাও নজরে পড়ল না। প্রতিটি বাড়ির সঙ্গে অনেকটা জায়গাজুড়ে তরিতরকারির বাগান। এতটুকু জায়গা ফেলে রাখেনি জার্মান জাতি।

আমি আর আমার ছেলে পথ হাঁটছি। সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপার থেকে অচিন দেশের যাত্রী আমরা। রাস্তার লোকগুলো হ্যাঁ করে তাকিয়ে দেখছে- এরা কারা? শ্বেতচর্ম অধিবাসীর মাঝখানে কে এই দুটি লোক যারা বাদামি অস্তিত্ব নিয়ে এল? বিশোরী জার্মান মেয়েরা খিলখিল করে হাসছে। আমরা অদৃশ্য হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের হাসির বিরাম নেই। মাঝে মাঝে কেউ কেউ টুপি খুলে আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছে, কেউ পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জার্মান ভাষায় ‘শুভদিন’, ‘শুভসন্ধ্যা’ জানিয়ে যাচ্ছে। আর প্রত্যেকটি মেয়ে-পুরুষ মৃদু হেসে যেন এ কথাই বোঝাতে চাইছে- অচিন দেশের হে যাত্রী-যুগল, আমাদের দেশের পরম আদরের অতিথি তোমরা।

হোটেলের পরিচারিকারাও আমাদের সুখ-সুবিধা আর স্বাচ্ছন্দ্যবিধানে প্রচুর যত্ন নিচ্ছে। সন্ধ্যায় টাউন হলে ট্রসিংগেন শহরের মেয়র ডেলিগেটদের অভ্যর্থনা জানালেন। চিরাচরিতভাবে এসব অনুষ্ঠানে যা হয় তা-ই হলো।

যে স্মৃতি কখনো ভোলা যায় না

কাজী নজরুল ইসলামকে প্রথম দেখি আমি যখন কোচবিহার কলেজে বিএ ক্লাসের ছাত্র। স্কুল ও কলেজের মিলিত বার্ষিক মিলাদ উপলক্ষে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি কোচবিহারে আসেন। স্টেশনে গিয়েছি তাঁকে অভ্যর্থনা করে আনার জন্য। ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরা থেকে তিনি নামলেন। প্রথম দৃষ্টিতেই কী বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন! মাথায় বিরাট কালোকৃষ্ণ বাবলি চুল, বিশালায়ত আঁখি আর মোমলাগানো এক জোড়া গোঁফ। শোভাযাত্রা করে তাঁকে কলেজ হোস্টেলে নিয়ে আসা হলো। সৌভাগ্যবশত আমার প্রকোষ্ঠেই তাঁর শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

দুপুরে মিলাদ অনুষ্ঠান শেষ হলো। নতুন মসজিদ প্রাঙ্গণে বিকেল চারটা থেকে কবির বক্তৃতা। তিনি বক্তৃতা দিচ্ছেন আর চার-পাঁচ মিনিট পরপরই বলছেন, ‘আপনারা এই মিলাদ উপলক্ষে আমার বক্তৃতা শোনার জন্য আমার কাছ থেকে যা আশা করছেন, সে আশা পূর্ণ করতে পারব না। আমি বক্তা নই, বক্তৃতা দিতে উঠলে আমি কথার খেই হারিয়ে ফেলি। আমার যা বক্তব্য আমি গানে বলতে চেষ্টা করি।’

আসরের নামাজের জন্য সভার কাজ পনেরো মিনিট বন্ধ রইল। নামাজ শেষে পুনরায় সভার কাজ শুরু হলো। কবি বলে উঠলেন, ‘আপনারা আমাকে মিলাদের সভায় ডেকে এনে ধর্ম সম্বন্ধে অনেক কিছু শুনবেন আশা করেছিলাম, কিন্তু আমি ধর্ম বিষয়ে কী বলব ?

যৌবনই আমার ধর্ম, যৌবনের কর্মচাঞ্চল্যের প্রতিটি মুহূর্তই আমার এপার-ওপারের পাথেয়। আমার কথা হলো, বর্তমানে বড় ধর্ম দেশের কাজ। পরাধীনতার গ্লানি আর আপনারা কতকাল বয়ে চলবেন? আপনারা লক্ষ্য করেছেন, আসরের নামাজ আমি পড়লামনা। পরাধীন দেশে কী করে নামাজ পড়ি? আমার দেশ স্বাধীন না হলে আজ নামাজ পড়তে বসে যদি ইংরেজ আমার জায়নামাজ কেড়ে নেয়...?’

এ কথা শোনামাত্রই সভায় উঠল অস্ফুট গুঞ্জন। সে গুঞ্জন ক্রমশ কলহে পরিণত হতে চলল। আমরা ছাত্ররা বেগতিক দেখে তাঁকে নিয়ে হোস্টেলে সরে পড়লাম। সন্ধ্যার পর বৈরাগীদিঘীর ধারে কোচবিহার ক্লাব প্রাঙ্গণে তাঁর গানের আসর বসল। শহরের আবালবৃদ্ধবনিতা সে আসরে ভিড় জমিয়েছে। সন্ধ্যা থেকে রাত এগারোটা অবধি সেখানে তিনি একা গেয়ে চলেছেন তাঁর শিকল পরার গান, চরকার গান, জাতের নামে বজ্জাতি ইত্যাদি। গানে-আবৃত্তিতে সবার প্রাণে এনে দিলেন যৌবন-জোয়ার।

কোচবিহার করদ-মিত্র রাজ্য। ইংরেজের বিরুদ্ধে এত কথা এত গান বড় বড় কর্তাদের কানে গেল। পুলিশের কর্মচারীরা সাদা পোশাকে হোস্টেলের আশপাশে আনাগোনা শুরু করল। কাজী সাহেব নির্বিকার। তাঁকে নিয়ে এ-বাসা সে-বাসায় চললো ঘরোয়া জলসা। আমি তখন কলেজ ম্যাগাজিনে গল্প লিখি। আর্য সাহিত্যসমাজ থেকে আমি ‘কাব্যরত্নাকর’ উপাধি পেয়েছি। নামের শেষে সেই উপাধিটা দেখে কাজী সাহেব বলে উঠলেন, ‘এত অল্প বয়সে এত বড় লেজ লাগিয়েছে কেন?’ লজ্জায় মরে গেলাম। জীবনে অতঃপর আর এ উপাধিটা কোথাও ব্যবহার করিনি। বন্ধুবান্ধবের মধ্যে কেউ হয়তো গোপনে আমার শত্রুতা সাধন করেছিল, কারণ কাজী সাহেব বলে উঠলেন, ‘তোমার লেখা গল্প তো পড়লাম, এবার একখানা গান শোনাও দেখি?’ আমি এবার সত্যি লজ্জায় যেন মিইয়ে গেলাম। শিল্পীদের প্রথম জীবনে এটা হয়ই। কেউ যদি বলে, ‘এ বেশ গায়’, অমনি বলা হয়, ‘যাহ, মিথ্যুক কোথাকার।’ কিছুতেই সংকোচ কাটিয়ে হারমোনিয়ামের পাশে যেতে পারছি না। কাজী সাহেব বলে উঠলেন, ‘তুমি ভয় পেয়ো না, আমি কোনো ভুল ধরব না, নিশ্চিন্তে গেয়ে যাও।’ রবীন্দ্রসংগীত ধরলাম- ‘সে আসে ধীরে যায় লাজে ফিরে’। কাজী সাহেব মহা উৎসাহে আমার পিঠ চাপড়ে বলে উঠলেন, ‘অদ্ভুত মিষ্টি কণ্ঠ! দেখো, তোমার নিজের চেহারা যেমন আয়না ছাড়া তুমি নিজে দেখতে পাও না, তেমনি তোমার গলার সুরও কত মিষ্টি তুমি নিজে বুঝতে পারবে না, যদি না রেকর্ডের মাধ্যমে শোনো। তুমি কলকাতা চলো, গান রেকর্ড করাব তোমার।’

এর দুই বছর পর কলকাতা গিয়ে গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজী সাহেবকে দেখে থমকে গিয়েছিলাম। সে গোঁফ আর নেই, সেই বলিষ্ঠ দেহ আর নেই। শরীরটা হয়েছে থলথলে, নাদুসনুদুস, তবে মাথার চুলগুলো আর সেই আয়ত আঁখির মদিরা ঠিকই আছে। একটু গম্ভীর প্রকৃতির মনে হলো।

কিন্তু এ গাম্ভীর্য যে তাঁর কপট গাম্ভীর্য, তা টের পেলাম দুদিনেই। কোথায় গাম্ভীর্য? এই লোক গম্ভীর হয়ে কি পাঁচ মিনিটও থাকতে পারে? বেশ গম্ভীর, চায়ে দু-তিন চুমুক দিয়ে একটা পান মুখে দিলেই মুখ থেকে খই ফুটতে আরম্ভ করল। তারপর তিনি গল্প আরম্ভ করলে সে আসরে আর গল্প জমায় কার সাধ্যি? শুধু কি গল্প? হাসি? এমন দিলখোলা উচ্চহাসি যে না শুনেছে, সে কল্পনাও করতে পারবে না হাসি কী জিনিস। গ্রামোফোনের রিহার্সেল কক্ষে বলুন, তাঁর বাড়িতেই বলুন, রেডিও অফিসে বলুন, দোতলা-তেতালা বাড়িগুলো যেন ফেটে পড়তে চাইত তাঁর এই হাসির শব্দে। সে হাসিতে সমতালে যোগ দিতে পারতেন আর দুটি মাত্র লোক, তাঁরা হচ্ছেন হাসির গান গাইয়ে হরিদাসবাবু আর রঞ্জিত রায়। আমরাও হাসতাম কিন্তু অত জোরে এবং অতক্ষণ ধরে নয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ওই ধরনের হাসি হাসলে আমাদের ফুসফুস ছিঁড়ে-হেঁচড়ে বেরিয়ে আসত হয়তো।

গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য অজস্র গান লিখেছেন তিনি। গানের খাতাগুলো সাধারণত কোম্পানীর রিহার্সেল রুমেই রেখে যেতেন। কোনো এক কবি তখন গ্রামোফোন কোম্পানিতে নতুন গান দেওয়া শুরু করেছেন এবং লব্ধপ্রতিষ্ঠিত দু'একজন শিল্পীর কণ্ঠে তাঁর রচিত গান গীত হয়ে রচয়িতা হিসেবে পরিচিত হচ্ছেন। এহেন কবি কাজিদার সেই সব গানের খাতা থেকে কবিতার বিষয়বস্তুই নয়, লাইনকে লাইন হুবহু নকল করে তাঁর গানের ফাঁকে ফাঁকে চালাতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। সুরশিল্পী কমল দাশগুপ্ত একদিন ‘কাজীদাকে বললেন, ‘কাজীদা, আপনি এভাবে গানের খাতাগুলো এখানে রেখে বাড়িতে যান, কিন্তু এমন কবিও এখানে উদয় হয়েছে, যারা আপনার এসব খাতা থেকে কবিতার শুধু ভাবই নয়, বরং লাইনকে লাইন তাদের রচনার ভেতর চালিয়ে যাচ্ছে।’

কাজীদা এ কথা শুনে প্রথমত একটু গম্ভীর হলেন, তারপর তাঁর স্বভাবসুলভ হাসি হেসে বলে উঠলেন, ‘আরে পাগল, মহাসমুদ্র থেকে কয় কলসি আর নেবে?’

হিংসা বলে কোন পদার্থ তাঁর মনে ছিল না। গোলাম মোস্তফার সঙ্গে কাজীদার

ইডিয়লজিতে খুব তফাত। এই গোলাম মোস্তফা কাজীদা’র ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সমালোচনা করে কবিতা লিখেছিলেন। অথচ রিহার্সেল রুমে যত দিনই কাজীদার সঙ্গে দেখা হয়েছে, তিনি আগেই দু হাত বাড়িয়ে গোলাম মোস্তফাকে আলিঙ্গন করেছেন।

বস্তুত ব্যক্তিগত জীবনে দু’জনের মধ্যে কোনো দিন কোনো মনোমালিন্য দেখিনি।

কাজীদার কাছে আমরা এই শিক্ষা লাভ করেছি। গিরীন চক্রবর্তী একদিন স্পষ্টই আমাকে বলেছিল, ‘তোমার ওপর আমার হিংসা হয়। দার্জিলিংয়ে প্রথম আমাদের বন্ধুত্ব। প্রায় একই সময়ে আমরা রেকর্ড-জগতে প্রবেশ করি, কিন্তু তোমার কেনই বা এত নাম আর আমার কেন হলো না।’ আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘কিন্তু ভাই, আমার চেয়ে তো কেষ্টবাবুর নাম, কই আমার তো কোনো দিনও সে জন্য হিংসা হয় না!’ এই সংগীত-জগতে বেশিদিন হয়তো আমি টিকে থাকতে পারতাম না, যদি না কাজীদার একদিনের একটা কথায় আমার চমক ভাঙত। রিহার্সেল রুমের দোতলায় বসে আমি একদিন কৃষ্ণচন্দ্র দের একখানা কীর্তন গাইছিলাম- ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না বঁধু ওইখানে থাকোগো’। কাজীদা কতোক্ষণ হলো দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন খেয়াল করিনি। আমি কিন্তু কেষ্টবাবুর ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে কী সংগীত ভেসে আসে’, ‘ফিরে চল ফিরে চল আপন ঘরে’, ‘অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রু বাদল ঝরে’- এই গানগুলো খুব গাইতাম আর গাইতাম অবিকল কেষ্টবাবুর গলার স্বর নকল করে।

কাজীদাকে হঠাৎ দেখে গান থামিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলাম। মৃণাল, ধীরেন দাস- এরা কাজীদাকে দেখে হেসে বললেন, ‘দেখুন কাজীদা, আব্বাস কী চমৎকার কৃষ্ণবাবুর নকল করেছে!’ কাজীদারও খুব খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু তিনি বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আব্বাস, চোখ তোমার অন্ধ হয়নি, বরং চশমা পর্যন্ত এখনো নাওনি। কাজেই সেদিক দিয়ে তুমি কানাকেষ্ট নও। তার ওপর ওর গলা নকল করে গান গাইলে জীবন ভরে তোমাকে এই অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে বেড়াতে হবে যে “আব্বাস! ওহ্, সে তো কেষ্টবাবুর নকল!” কাজেই কেষ্টবাবু কেষ্টবাবুই, ধীরেন দাস ধীরেন দাসই, মৃণাল মৃণালই আর আব্বাস আব্বাসই থাকবে। কখনো নিজের স্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা, যাকে বলে অরিজিনালিটি, নষ্ট করবে না।’

সেদিন থেকে অন্যের কণ্ঠ নকল করে গাওয়ার অভ্যাস চিরদিনের মতো ছেড়ে দিয়েছি। একদিন কাজীদার বাসায় বসে আছি, এমন সময় এক চীনাম্যান হকার পাশ দিয়ে হেঁকে যাচ্ছে, ‘সিল্কের কাপড় চাই-’।

কাজীদার ইঙ্গিতে তাকে ভেতরে নিয়ে আসা হলো। এ কাপড় সে কাপড় দেখে তার দুই পুত্রের জন্য কয়েক গজ সিল্ক কেনা হলো। দাম যা চাইল, তা-ই দিয়ে দিলেন।

এর চার-পাঁচদিন পর আবার সেই চীনাম্যান হেঁকে যাচ্ছে কাজীদার বাসার পাশ দিয়ে। আজও তাকে ডাকা হলো। চীনাম্যান কাজীদার কথামতো সেদিনও সেই ধরনের কয়েক গজ সিল্কের কাপড় মেপে কেটে দিল। লক্ষ্য করলাম, আজ দামটা যেন দেড়গুণ বেশি। অম্লানবদনে সেই টাকাটাই তিনি দিয়ে ফেললেন। আমি বললাম, ‘কাজীদা, এই তো চার-পাঁচ দিন আগে খোকাদের জন্য এই কাপড়ই কিনলেন। সেদিন তো এর দাম দিয়েছিলেন-’। তিনি হেসে বললেন, ‘আরে, দুটো পয়সা লাভের জন্যই তো বেচারি অত বড় একটা কাপড়ের পাহাড় মাথায় করে বেড়ায়।’

মেগাফোন কোম্পানিতে আমি একদিন একটা ভাওয়াইয়া গানের কলি আওড়াচ্ছিলাম। কাজীদা কতক্ষণ ধরে যে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন টের পাইনি। গান শেষ হয়ে গেলেই তিনি ঘরে ঢুকে বললেন, ‘গাও তো আব্বাস, আবার গাও।’ আমি গানটা একবার গাইলাম। বললেন, ‘না, তুমি গেয়েই চল, যতক্ষণ আমি থামতে না বলি।’ চোখ বুজে গানটা বোধহয় দশ-পনেরো মিনিট গেয়েছি, এবার তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, এবার এই গানটা গাও দেখি, ঠিক ওই সুরে।’ এরই মধ্যে অবিকল সেই সুরে তাঁর গান লেখা হয়েছে। আমার গানের কলি ছিল-

‘নদীর নাম সই কচুয়া

মাছ মারে মাছুয়া

মুই নারী দিচোং ছেকাপাড়া-’

কাজীদা লিখলেন-

‘নদীর নাম সই অঞ্জনা

নাচে তীরে খঞ্জনা

পাখি সে নয় নাচে কালো আঁখি

আমি যাব না আর অঞ্জনাতে

জল নিতে সখি লো

ঐ আঁখি কিছু রাখিবে না বাকি।’

ভাওয়াইয়া গান শুনলেই কবি বড় চঞ্চল হয়ে উঠতেন। বহুদিন বলেছিলেন, ‘জানি না এ গানের সুরে কী মায়া; আমার মন চলে যায় কোন পাহাড়িয়া দেশের সবুজ মাঠের আঁকাবাঁকা আলোর প্রান্তিকে, উপপ্রান্তিকে।’ এরপর তাঁর প্রসিদ্ধ একখানা গানে তিনি আমাকে ভাওয়াইয়া সুরই সংযোগ করতে বলেছিলেন। সে গান হচ্ছে, ‘কুঁচবরণ কন্যারে তার মেঘবরণ কেশ’।

গ্রামোফোন কোম্পানিতে একদিন সবাই বসে বেশ গুলতানি গল্প করছিলাম। এমন সময় কাজীদার প্রবেশ। তিনি বললেন, দেখো, হঠাৎ যদি আজ লটারিতে তোমরা একলাখ টাকা পাও, তাহলে তোমাদের বউ বল প্রিয়া বল, তাকে কী কী জিনিস দিয়ে সাজাবে তোমরা?’ একেকজন একেক রকম বলল। কেউ বা ট্যাক্সি করে এমবি সরকারের দোকানে গিয়ে হিরে-জহরতের জড়োয়া সেট কিনবে বলল, কেউ বা ওয়াছেল মোল্লার দোকানের শাড়ির যত রকম ডিজাইন আছে, সব কিনবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজীদা হারমোনিয়ামটা টেনে বলে উঠলেন, ‘শোনো আমি কী দিয়ে প্রিয়াকে সাজাতে চাই’, বলেই গান ধরলেন-

মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেব খোঁপায় তারার ফুল

কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতি চাঁদের দুল।

কণ্ঠে তোমার পরাব বালিকা

হংস-শাড়ির দোলানো মালিকা

বিজলি জরির ফিতায় বাঁধিব মেঘ রং এলো চুল।

জোছনার সঙ্গে চন্দন দিয়ে মাখাব তোমার গায়

রামধনু হতে লাল রং ছানি আলতা পরাব পায়

আমার গানের সাত সুর দিয়া

তোমার বাসর রচিব প্রিয়া

তোমারে ঘিরিয়া গাহিবে আমার কবিতার বুলবুল।

গান শেষ হলে বললেন, ‘কি, মহরথীর দল, ক টাকা লাগল প্রিয়াকে সাজাতে?’

কাজীদার খাতায় একখানা গান দেখে বড় লোভ হলো গানটা নেওয়ার জন্য। বললাম, ‘কাজীদা এ গানটা আমি রেকর্ড করতে চাই।’ তিনি বললেন, ‘স্বচ্ছন্দে।’ তক্ষুনি গানটা আমাকে শিখিয়ে দিলেন। এর দু’দিন পরই বিশেষ কোনো কাজ উপলক্ষে আমাকে দেশে যেতে হয়- সেখানে আটকা পড়ে থাকি প্রায় দুই মাস। ফিরে এসে কাজীদাকে বললাম, ‘দাদা, ওখানা গানের সুর তো তোলা হয়ে গেছে- রেকর্ডের অপর পৃষ্ঠার গানটা আজ শিখিয়ে দিন।’ তিনি বললেন, ‘ওহো, বড্ড ভুল হয়ে গেছে, গানটা জোর করে পদ্মরানী চ্যাটার্জি নিয়ে রেকর্ড করে ফেলেছে।’ কী আর বলব, দুঃখে চোখে পানি এল। বাজারে যখন সে রেকর্ড বের হলো, আমি গানের সুর শুনে কাজীদাকে বললাম, ‘কাজীদা, এ গান যে জবাই করা হয়েছে।’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি তোমাকে যে সুর শিখিয়েছি, মেয়েটা কিছুতেই সে সুর আয়ত্ত করতে পারল না, কাজেই সহজ সুরই দিতে হলো। জানি, এ গানের এ সুর গানের বাণীকে রূপায়িত করতে পারেনি।’ সে গান হচ্ছে ‘যবে তুলসীতলায় প্রিয় সন্ধ্যাবেলায় তুমি করিবে প্রণাম।’

ইসলামি গানের যখন ভীষণ চাহিদা, তখন কাজীদার বাসায় গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। প্রথমে বাসায় যেতেই তাঁর এক চাকর ‘হইরা’ বা ‘হরি’ বলে উঠত- ‘নাই, কাজী সাহেব বাসায় নাই।’ প্রথম প্রথম ওই কথা শুনে ফিরে আসতাম। একদিন যেই ‘হইরা’ বলে উঠল, ‘নাই, কাজী সাহেব বাসায় নাই’ অমনি অন্য ঘর থেকে ভেসে এল কাজীদার হাসির শব্দ। এর পরও গতানুগতিকভাবে একই উত্তর পেতাম হইরার কাছে; কিন্তু ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ বসলেই ঠিক দেখা পেতাম কাজীদার। পরে এক গূঢ় তত্ত্ব উদ্‌ঘাটন করেছি। কাজীদাকে পাওনাদার প্রায়ই বিরক্ত করত। তাই চাকরের ওপর এ নির্দেশই ছিল। কিন্তু সেই হাবাকান্ত এটাও বুঝতে পারেনি যে, পাওনাদারের পর্যায়ে আমি নই। অবশ্য আমার উপস্থিতিটা একজনের খুব মন: পূত হতো না এবং এ কথা আজ লিপিবদ্ধ করতে মনের দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারছি না, তবু সত্যের খাতিরে লিখে যাচ্ছি। কাজীদার শাশুড়ি আমাকে সহ্য করতে পারতেন না। কারণ, ইসলামি গান কাজীদা লিখুন, এটা তাঁর অভিপ্রেত ছিল না। কী করে বুঝলাম, সেই কথাটাই বলছি। একদিন আমি যে বাইরের ঘরে বসে আছি, সেটা তিনি হয়তো ভেতর থেকে জানতেন না।

সক্কালবেলা কাজীদা আমার ইসলামি রেকর্ডের একখানা নেগেটিভ কপি বাজাচ্ছিলেন। তাঁর শাশুড়ি বাইরের ঘরের পাশ থেকেই বলে উঠলেন, ‘সক্কালবেলা নুরু আর গান পেল না- কী সব গান বাজানো শুরু করে দিল।’ আমাকে দেখলে হয়তো কাজীদাও লজ্জা পাবেন, তাই চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

কাজীদার লেখা ইসলামি গানগুলোর শতকরা ৯৫ ভাগই তাঁর নিজস্ব সুর সংযোগ করা। মাত্র অল্প ক’টি গান তিনি দিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত আর চিত্ত রায়কে সুর করে আমাকে শিখিয়ে দেওয়ার জন্য। ইসলামি গানে তিনি যে কী অপূর্ব সুরই সংযোগ করেছিলেন, যাঁরা সুরজ্ঞ বা গানের সমঝদার তাঁরা এ কথা স্বীকার করবেনই।

স্বদেশী যুগে ধীরেন দাসের কণ্ঠে ‘শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও ইত্যাদি গান বিশেষ আদৃত হচ্ছে তখন। কাজীদা বললেন, ‘আব্বাস, দুখানা স্বদেশী গান গাইবে?’ রাজি হলাম তক্ষুনি। তিনি দু’খানা গান শিখিয়ে দিলেন। একখানা হচ্ছে ‘ভোলো লাজ ভোলো গ্লানি জননী মুক্ত আলোকে জাগো’, আরেকখানা ‘নম নম বাংলাদেশ মম চিল মনোহর চির মধুর’। গান দুখানার বাণী কী অপরূপ!

মৃণালকান্তি ঘোষ আর আমি দুজনে মিলে কাজীদার দুখানা গান রেকর্ড করি। ঢাকায় যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে, কাজীদা তখুনি এ গান লিখে দিয়েছিলেন- ‘ভারতের দুই নয়নতারা হিন্দু-মুসলমান’, আরেকখানা ‘হিন্দু আর মুসলিম মোরা দুই সহোদর ভাই।’

একবার দার্জিলিংয়ে কাজীদার সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, ‘আব্বাস, রবীন্দ্রনাথ (তিনি বলতেন গুরুদেব) এসেছেন এখানে, চলো দেখা করতে যাই।’ আমি বললাম, ‘চলুন।’ একদল যুবক চলেছি। ম্যল-এর কাছে এসে আমি চট করে অন্য পথ ধরে একদম হাওয়া হয়ে গেলাম। পরদিন কাজীদা আমাকে খুব গালাগালি করে বললেন, ‘দেখো, আমি গুরুদেবকে প্রণাম করেই বলে উঠেছি- গুরুদেব আজ একটি ছেলের অপূর্ব কণ্ঠ শোনাব আপনাকে, তারপর হাতড়ে দেখি, তুমি একদম নাই। কি আশ্চর্য!’

কলকাতায় আরও দুবার আমাকে কাজীদা কবিগুরুর কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু যাইনি কেন তা-ই বলছি।

রাইটার্স বিল্ডিংয়ে তখন আমি রেকর্ডিং এক্সপার্টের কাজ করি। বাড়ি যাব বলে কদিনের ছুটি নিয়েছি। সেই রাতেই দার্জিলিং মেইলে রওনা হব। অফিসে এসে দেখি সবাই উন্মনা। কী হবে কী হবে, রবিঠাকুর বুঝি আজ...। কিছুক্ষণের মধেই সাড়া পড়ে গেল, রবিরশ্মি চিরতরে নির্বাপিত। অফিসের সব লোক ছুটছে ঠাকুরবাড়ির দিকে। গিয়ে দেখি জনসমুদ্র। কার সাধ্য ভেতরে ঢোকে! তিন-চার ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর আবার ফিরে এলাম অফিসের দিকে। অফিস একদম জনমানবশূন্য। কে একজন বলল, তোমাকে টেলিফোনে ডাকছে।’ ধরলাম ফোনটা। কলকাতা রেডিওর স্টেশন ডিরেক্টর নৃপেন মজুমদার বলছেন, ‘আব্বাস, একবার রেডিও অফিসে এসো। সবাই রবীন্দ্রনাথের তিরোধানে গান দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন, তুমিও এসো।’ আমি কেমন যেন তখন উন্মনা। আমার ভেতরে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। লালদীঘির ঘাটে কতক্ষণ বসে ছিলাম মনে নেই। প্রায় ছয়টার সময় রেডিও অফিসের দিকে এগিয়ে গেলাম। একেকজন শিল্পী গাইছেন, আর গানের শেষে চোখ মুছতে মুছতে স্টুডিও থেকে বেরিয়ে আসছেন। আমাকে গাইতে বলা হলো, গাইলাম, ঐ ঝড়ের মেঘের কোলে, বৃষ্টি আসে মুক্তকেশে আঁচলখানি দোলে।’ প্রায় দশ মিনিট ধরে গাইলাম। জানি না, প্রকৃতির এই শান্ত সমাহিত ভাবাবেশ কেন সেই মুহূর্তে অশান্ত হয়ে উঠেছিল। ওদিকে যখন রবীন্দ্রনাথকে যখন চিতায় তোলা হয়েছে, এদিকে তখন চলেছে আমার বর্ষার গান, আর ঠিক সেই মুহূর্তটিতে আকাশও অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি। এসেছিল একঝাঁক বৃষ্টি অশ্রুধারারূপে। নৃপেনদা সমস্ত আর্টিস্টকে জানিয়েছিলেন, এই স্বতঃস্ফূর্ত আত্মনিবেদনের জন্য ধন্যবাদ। আমাকে বলেছিলেন, ‘আব্বাস, তুমিই কিন্তু হার মানিয়েছ সবাইকে। ধরেছ বর্ষার গান। মেঘশূন্য আকাশ। বৃষ্টি হলো ঠিক সেই সময়টাতে, যখন চলছে তোমার গান আর গুরুদেবের দেহ ঠিক চিতার ওপর।’ রবীন্দ্রনাথের তিরোধানে কাজীদা বড় ভালো গান লিখলেন একখানা। গাইল সেখানা যুথিকা রায়। কাজীদা দুঃখ করে বললেন, ‘আব্বাস, কত দিন তোমাকে বলেছিলাম গুরুদেবের কাছে চলো, গেলে না, জীবনে এ আফসোস আর যাবে না।’ আমি বললাম, কাজীদা, একটা গল্প শুনবেন? আইএ পরীক্ষা দিয়ে ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম মহাত্মা গান্ধীকে দেখার জন্য। তিন দিন অঝোরধারায় বৃষ্টি। পচা এক হোটেলে খাই আর সারা রাত মশার জ্বালায় ছটফট করি। তিন দিনের পর বৃষ্টি থামল, মহারাজ শশীকান্ত আচার্যের বাগানবাড়িতে মহাত্মা বিকেল চারটায় দর্শন দেবেন। বেলা দুইটায় গিয়ে মঞ্চের কাছাকাছি আসন নিলাম। মানে দাঁড়িয়ে রইলাম। অত:পর যেদিকে চাই, শুধু লোক আর লোক। ভাবছি, এই লোক পারাবার পার হয়ে বের হব কী করে? যাক, গোটা পাঁচেকের সময় মহাত্মার আবির্ভাব হলো। মুণ্ডিতমস্তকই মনে হলো। কৌপিন পরিহিত, আবক্ষ উন্মুক্ত। এ-ই মহাত্মা গান্ধী! ক্ষীণকণ্ঠে বললেন- চরকা কাটো, খদ্দর পিনহো, বারিষ হো রহি হ্যায়, ঘর যাও।

‘ঘরে, মানে হোটেলে এলাম। এসে পুঁটলি নিয়ে সোজা স্টেশনে এবং ঘরমুখো টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে বসলাম।

‘বিশ্বাস করবেন কাজীদা, সারাটা পথ কী বিরাট আলোড়ন মনের মধ্যে? প্রতিজ্ঞা করতে লাগলাম, জীবনে বিরাট ব্যক্তিত্বপূর্ণ মনীষীকে আর সান্নিধ্যে এসে দেখব না। তাই আমার ধ্যানের কবিগুরুকে ধ্যানের রাজ্যেই রেখেছি। আমার রবীন্দ্রনাথ সুনীল আকাশের গায়ে রজতশুভ্র মেঘের সিংহাসনে বসে অবিরাম লিখে চলেছেন কাশপালকের শুভ্র লেখনী দিয়ে মহাকালের শুভ্র খাতায়। দুগ্ধফেননিভ ঝরনার জলের স্রোতের মতো নেমে আসছে সেই কবিতার কলকাকলি নৃত্যের ছন্দে অবিরাম। মর্ত্যের মুগ্ধ শিষ্য আমি, দুহাত ভরে অঞ্জলি পুরে সেই কবিতার মদিরা পান করে বুঁদ হয়ে আছি। মহাত্মা গান্ধী সন্দর্শনে ধ্যান আমার ভেঙে গিয়েছিল। কল্পলোকের রবীন্দ্রনাথকে তাই আমার কল্পলোকেই রেখেছি।’

কাজীদা বললেন, ‘বড় চমৎকার, কিন্তু আব্বাস, রবীন্দ্র-দর্শনে তোমার সে ধ্যান ভাঙত না। অমন সুপুরুষ..’। আমি বাধা দিয়ে বললাম, কাজীদা, রবীন্দ্রনাথের ফটোও তো দেখি, বাস্তবের রবীন্দ্রনাথের চেয়েও আমার অশরীরী রবীন্দ্রনাথ কত সুন্দর, এ আপনাকে বোঝাই কী করে! জানেন কাজীদা, দেবদাস বই দেখে আমি কী কান্নাটাই কেঁদেছি! আমার কল্পনার পারুল কি এই মর্ত্যবাসিনী যমুনা? না না, কাজীদা-

‘সে কেন দিল রে দেখা

না দেখা ছিল যে ভালো।’

যুদ্ধের বাজারে ভারত সরকার থেকে একটা ডিপার্টমেন্ট খোলা হলো- সং পাবলিসিটি অর্গানাইজেশন। কলকাতায় বোমা পড়ার আতঙ্কে তখন অনেকেই পলায়ন-তৎপর। বাঙালির এই গুণের সদ্ব্যবহার করতে আমিই বা পশ্চাৎপদ হব কেন। পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গেলাম। ছুটির পর ছুটি অর্থাৎ দরখাস্ত দিয়ে দিয়ে প্রায় তিন মাস বাড়িতে কাটিয়ে কলকাতা ফিরে এলাম ভয়ে ভয়ে। চাকরি আমার আছে, আবু হেনা তখন পাবলিসিটির ডিরেক্টর। তিনি তাঁর ঘরে নিয়ে গিয়ে আমাকে বেশ বকুনি দিয়ে বললেন, ‘যুদ্ধের ভয়ে দেশে গিয়ে লুকিয়ে আছেন, আরেক দিকে যে আপনার জন্য একটা চাকরি নিয়ে বসে আছি। এই দেখুন ফাইল। সং পাবলিসিটি অর্গানাইজার, আরেকজন অতিরিক্ত অর্গানাইজার নেওয়া হবে। আমি ঠিক করে রেখেছি, কাজী নজরুল ইসলাম আর আপনাকে যথাক্রমে পোস্ট দুটো দেব। আপনি কাজীকে একবার অফিসে নিয়ে আসুন।’

তক্ষুণি ছুটলাম কাজীদার বাড়িতে। আমি দেশে যাওয়ার আগে শুনেছিলাম যে নবযুগ অফিসে তিনি হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু এই অসুস্থতার জের যে তিনি তখনো টেনে চলেছেন, সেটা ধারণাও করতে পারিনি। আমি জানতাম, সাংসারিক অর্থকৃষ্ট্রের জন্য তিনি খুবই মনমরা হয়ে থাকতেন, কিন্তু চির বিদ্রোহী বীরের কাছে সরকারি চাকরির কথা কী করে প্রস্তাব করব, সেই সমস্যায় দিশেহারা হয়ে তাঁর সামনে বসে ভাবছি। তিনি বেশি কথা বলছেন না, হাতে একখানা রুমাল। লোকজন সামনে এলে ঘন ঘন সেই রুমালে মুখ মোছেন, অন্য সময় নাকি ঘরের দেয়াল-মেঝে থুতু দিয়ে ভরিয়ে ফেলেন। শুনেছিলাম একটু মস্তিষ্ক বিবৃতি ঘটেছে। সেটার প্রমাণ পেলাম যখন তাঁকে বললাম, ‘কাজীদা, নবযুগ আর কত টাকা দেয় আপনাকে, তাছাড়া খবরের কাগজ তো আজ আছে কাল নেই। আচ্ছা, যদি ধরুন এই পাঁচ শ টাকা মাইনের একটা সরকারি চাকরি হয়, আপনি করতে রাজি আছেন?’ তাঁর চোখে-মুখে ফুটে উঠল কী আনন্দোচ্ছল ভাব, যেন দেখতে পেলেন চোখের সামনে পাঁচ শ টাকা। আমার হাতটা তিনি চেপে ধরলেন, মুখচোরা সেই সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে তিনি সমর্থন জানালেন এ প্রস্তাবকে। কাজীদার বড় ছেলে সানি সামনে দাঁড়িয়ে। বললাম, ‘আসছে কাল আমি ঠিক দশটার সময় এসে এঁকে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে নিয়ে যাব, তোমরা কাজীদাকে সাজিয়ে রাখবে।’

পাশের ঘরে এলাম- সানির মা আমাকে বললেন, ‘আব্বাস, চাকরি ওঁর হবে?’ আমি তখন কোন সুদূরে- হায়, এই কাজীদা, যাঁর হাতে ছিল বিষের বাঁশি, যিনি বীণাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন অগ্নিবীণা, ইংরেজের পরাধীনতার শিকল ভেঙে যে নির্ভীক সেনানী সারা বাংলার তরুণদের হাইদরি হাঁকে ডেকে গেছেন- দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার পার হয়ে অমৃতের দ্বারে পৌঁছানোর জন্য, যে বীর দেশের মুক্তির জন্য প্রথম পথপ্রদর্শন করেছেন দীর্ঘ ৪৫ দিন কারাগারে অনশন-ব্রত উদ্যাপন করে- পায়ের বেড়ি, হাতের নির্মম শিকলকে যে শিল্পী নূপুরের মতো মনে করে গেয়েছেন শিকল পরার গান, গ্রাম হতে গ্রামান্তরে, শহর থেকে উপপ্রান্তিকে যে চারণ গেয়ে ফিরেছেন চরকার গান, সেই কবি কিনা দাসখতে নাম লেখাতে বলায় তিলমাত্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করলেন না, একি সত্যি মস্তিষ্কবিকৃতি নয়?

ভাবি বলে উঠলেন, ‘আব্বাস, কাল তো তুমি নিতে আসবে ওঁকে, কিন্তু ও তো বেশি কথা বলতে পারে না?’ আমার যেন চমক ভেঙে গেল। আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী বললেন, ভাবি?’ ভাবির চোখের পানি এল। চোখ মুছে বললেন, ‘জানি ভাই, ওকে চাকরি করতে হবে এই কথাটাই ভাবছিলে, কেমন?’ আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘ভাবি, দুনিয়ায় মানুষ অবস্থার দাস। কিছুই ভাববেন না। কাজীদার শারীরিক অসুস্থতার মূলই তো হচ্ছে সাংসারিক অভাব-অভিযোগ। দেশের জন্য তিনি এত করেছেন কিন্তু দেশ যখন এগিয়ে এল না, তখন যেমন করেই হোক টাকা তাঁকে রোজগার করতেই হবে। তবে ওঁকে এক মুহূর্তও খাটতে দেব না, ওর সহকারী হব আমি।’ এ কথায় তিনি যেন আশ্বস্ত হলেন। আবার সেই প্রথম কথাই বললেন, ‘উনি তো বেশি কথা বলেন না। ইন্টারভিউতে-’। আমি বাধা দিয়ে বললাম, ‘ইন্টারভিউ কিছুই নয়। আমার সঙ্গে উনি থাকবেন, যা বলারআমিই বলব।’

পরদিন তাঁকে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে নিয়ে এলাম। হেনা সাহেব কাজীদাকে দেখে চেয়ার থেকে উঠে এসে অতি সম্মানে তসলিম করে তাঁকে একখানা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। কাজীদার মুখে রুমাল, কারণ সেই রুমালে ঘন ঘন থুতু ফেলতে হয়, ইশারায় বললেন, ‘পানি খাব।’ তক্ষুণি তাঁকে পানি দেওয়া হলো। ইতিমধ্যে চা এসে গিয়েছিল। পরম আনন্দে চা পান করছেন। হেনা সাহেব তাঁকে বললেন, ‘কাজী সাহেব, পারবেন তো কাজ করতে?’ মাথা দুলিয়ে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’, আর আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘ও’। হেনা সাহেব হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, আব্বাস সাহেবই আপনার সহকারী হবেন। ছোটাছুটি এটা-ওটা সবই উনি করবেন, আপনি শুধু আমাদের ফরমাশমতো দুটো গান, কবিতা লিখবেন, ব্যস।’

হয়তো চাকরিটা হলে তাঁর অভাব ঘুচত, সাময়িক মস্তিষ্কবিকৃতি হয়তো কেটে যেতে পারত, কিন্তু মানুষ ভাবে এক, খোদা করেন আরেক। পুলিন বিহারী মল্লিক তখন প্রচার দপ্তরের মন্ত্রী। জানি না, কী করে কাজীদার এই সামান্যতম অসুস্থতার খবরটি তাঁর কর্ণমূলে প্রবেশ করে। তাঁর স্বজনকে এই স্থলাভিষিক্ত করা যায় কী করে, এই নিয়ে তাঁর জল্পনাকল্পনা চলল। হেনা সাহেবের পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলল। যে চাকরিতে বিনা দ্বিধায় কাজীদা ও আমাকে বসিয়ে দেওয়ার কথা, সেখানে পোস্ট দুটোর জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। বলাইবাহুল্য, কাজীদাকে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে উপস্থিত করা মানে ওই কবি প্রতিভার চূড়ান্ত অপমান। কাজীদার বাসায় গিয়ে ভাবিকে বললাম মন্ত্রীর চক্রান্তের কথা। তিনি বললেন, ‘না, চাকরির জন্য দরখাস্ত দেওয়া হতেই পারে না। তুমি ঠিকই বলেছ।’

আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা দরখাস্ত করলাম। বাংলার লব্ধপ্রতিষ্ঠ বহু সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ দরখাস্ত করেছেন ইন্টারভিউয়ের দিনে দেখলাম। একে একে কুড়ি-পঁচিশজন ইন্টারভিউ দিলাম। চাকরি আর আমার হবে না জানি, তবু ইন্টারভিউতে ভালো করলাম মনে হলো। ফল বের হলো। মন্ত্রীর প্রার্থী সুরেশবাবু প্রথম, জসিম দ্বিতীয়, আর আমি তৃতীয় নমিনেশন পেলাম।

(সংগীত শিল্পী আব্বাসউদ্দীন রচিত “আমার শিল্পী জীবনের কথা” গ্রন্থ থেকে কিছু কিছু অংশ একত্রিত করে “আব্বাসউদ্দীনের আত্মজৈবনিক স্মৃতি” শিরোনামে প্রেক্ষণে মুদ্রিত হলো। আশা করি পাঠক সমাদ্রিত হবে।—প্রেক্ষণ সম্পাদক)

হদিস : সাহিত্য ত্রৈমাসিক “প্রেক্ষণ” (জুলাই – সেপ্টেম্বর, ২০১২)