
স্যার সৈয়দ আহমদ খান এবং দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম জাতীয়তাবাদের উদ্ভব
(পাকিস্তানের ডন প্রত্রিকায় ১৫ আগস্ট ২০১৬ সালে প্রকাশিত “The forgotten future: Sir Syed and the birth of Muslim nationalism in South Asia” এর ঈষৎ সংক্ষেপিত-পরিমার্জিত অনুবাদ।)
পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ছিল ১৯শ শতকে ভারতে উদ্ভূত মুসলিম জাতীয়তাবাদের সরাসরি ফলাফল। আর এর বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রদূত ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান।
সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থা নিয়ে সৈয়দ আহমদের লেখালেখি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তার সক্রিয়তা এই অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ধারণাগুলোর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
এই ধারণাগুলো পরবর্তীতে মুসলিম বুদ্ধিজীবি, পণ্ডিত, রাজনীতিবিদ, কবি, লেখক এবং সাংবাদিকদের প্রভাবিত করে। তারা সৈয়দ খানের মুসলিম জাতীয়তাবাদের ধারণাকে আরো বিকশিত করে এটিকে পাকিস্তানের আদর্শিক মূলনীতি এবং রুহ আকারে প্রতিষ্ঠিত করেন। সৈয়দ খানের প্রভাব পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক গঠনে জোরালোভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল।
তবে এই প্রভাব ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে হ্রাস পেতে শুরু করে। এ সময়ের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অর্থনৈতিক সংকট এবং ১৯৭১ সালে ভারতের সঙ্গে এক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ পাকিস্তানি সমাজকে তীব্রভাবে বিভক্ত করে তোলে। প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের অভাবে এই বিভাজন ধীরে ধীরে নব্য-প্যান-ইসলামিজমের মতো অন্যান্য প্রবণতাগুলোর মাধ্যমে আরো স্পষ্ট হতে শুরু করে।
প্যান-ইসলামিক এই বিকল্প নতুন প্রজন্মের শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে প্রবল সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। আধুনিক মুসলিম জাতীয়তাবাদকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা তেলসমৃদ্ধ আরব রাজতন্ত্রগুলোর অর্থায়ন এর দ্রুত প্রসারে ভূমিকা রাখে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রও তার কৌশল পরিবর্তন করে এবং প্যান-ইসলামিজমের বিভিন্ন দিককে আত্মস্থ করার চেষ্টা করে। এজন্য এমনকি তাকে রাষ্ট্রের অনেক মৌলিক জাতীয়তাবাদী ধারণাকেও ত্যাগ করতে হয়। আর এখান থেকেই পাঠ্যপুস্তক এবং জাতীয়তাবাদী আখ্যান থেকে সৈয়দ আহমদ খানের উপস্থিতি ধীরে ধীরে মুছে যেতে শুরু করে।
মুসলিম জাতীয়তাবাদ : ধর্মতাত্ত্বিক সূচনা
দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম জাতীয়তাবাদ মুসলিম শাসনামল শেষ হওয়ার আগে কোনোভাবেই গড়ে ওঠেনি। মুঘল সাম্রাজ্যের পতন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের উত্থান এবং ভারতে হিন্দুদের রাজনৈতিক পুনরুত্থান—এসব ঘটনাই মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক ভিত্তি গড়ে দেয়।
ড. মোবারক আলী ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে জাতিসত্তার ধারণা তৈরিতে একটি বিষয়ের ভূমিকাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, মুসলমানদের প্রিয় ভাষা হিসেবে ফার্সির পরিবর্তে উর্দুর প্রচলন শুরু হওয়াই এর অন্যতম প্রধান কারণ, কেননা উর্দু মুসলমানদের একটি আলাদা পরিচিতি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।
যখন মুসলিম শাসন দুর্বল হতে শুরু করে, তখন পারস্য ও মধ্য এশিয়া থেকে অভিবাসীদের ভারতে আসা এবং এখানে বসবাস করাও বন্ধ হয়ে যায়। কারণ তখন মুসলিম শাসকদের দরবারে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার সুযোগ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফলে ফার্সি ভাষার গুরুত্ব ও ব্যবহার কমে যেতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে এটি উর্দুর মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। উর্দু ভাষা মূলত ১৪শ শতাব্দী থেকেই ভারতে বিকশিত হতে শুরু করে।
এই ভাষাটি মূলত স্থানীয় মুসলমানদের (যাদের বেশিরভাগই ধর্মান্তরিত) মধ্যে প্রচলিত ছিল। তবে ১৯শ শতকের শুরুর দিকেই এটি অভিজাত মুসলিম শ্রেণির ঘরেও প্রবেশ করতে শুরু করে। এর ফলে স্থানীয় মুসলমানরা ধীরে ধীরে সামাজিকভাবে উঁচু স্তরে উঠার সুযোগ পায় এবং সেইসব পদ ও অবস্থান গ্রহণ করতে শুরু করে, যা আগে পারস্য এবং মধ্য এশিয়ার অভিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এর ফলে একটি নতুন মুসলিম গোষ্ঠীর উত্থান শুরু হয়। এই গোষ্ঠীর বেশিরভাগ সদস্যই ছিলেন সদ্য সামাজিকভাবে উন্নতির সুযোগ পাওয়া স্থানীয় মুসলমান।
কিন্তু এই পরিবর্তনগুলো এমন এক সময় ঘটছিল, যখন মুসলিম সাম্রাজ্য দ্রুত পতনের পথে ধাবিত হচ্ছিল এবং ব্রিটিশরা ভারতে তাদের ঘাঁটি শক্তিশালী করছিল। একইসঙ্গে শত শত বছর নিস্তেজ থাকার পর হিন্দুরাও এসময় সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করে। কিন্তু এই অঞ্চলে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করবে এমন শক্তিশালী মুসলিম শাসক বা অভিজাত শ্রেণির অভাব উদীয়মান স্থানীয় মুসলিম গোষ্ঠীকে তাদের নতুন পাওয়া উন্নত অবস্থান হারিয়ে ফেলার শঙ্কায় ফেলে দেয়। ব্রিটিশ শাসনের প্রসার এবং হিন্দুদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা তাদের এই শঙ্কা আরো বাড়িয়ে তোলে।
যদিও অনেক স্থানীয় মুসলমান সামাজিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তবুও কোনো শক্তিশালী মুসলিম শাসক না থাকার ফলে এই নতুন গোষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করতে শুরু করে এবং অনেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য পরবর্তী মুঘল শাসকদের বিলাসিতাকে দায়ী করতে শুরু করে। এমনকি অতীতের কিছু খ্যাতনামা মুসলিম শাসকদেরও এসময় সমালোচনা করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—তারা বাস্তবধর্মী রাজনীতি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিতে অতিরিক্ত আস্থাশীল ছিলেন। কিন্তু নিজেদের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপকহারে ধর্মান্তরের ব্যাপারে তারা যথেষ্ট পদক্ষেপ নেননি।
ভারতে মুসলিম শাসন যখন শিখরে, তখন রাষ্ট্রীয় কাজে উলামাদের নামমাত্র ভূমিকা পালনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যখন মুসলিম শাসন দুর্বল হতে শুরু করল, তখন উলামাগণ এই নতুন উদীয়মান মুসলিম গোষ্ঠীর মুখপাত্র হয়ে ওঠেন এবং তাদের আশা ও আশঙ্কাকে প্রকাশ করার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন।
উলামাগণ মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকে এই অঞ্চলে “প্রকৃত ইসলাম”-এর অবক্ষয়ের ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করতে থাকেন। তাদের মতে, মুঘলদের অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির কারণেই অনেক “বহিরাগত ধারণা” মুসলমানদের বিশ্বাস ও আচারে ঢুকে পড়ে, যে নীতি হিন্দুদের শক্তিশালী করেছিল এবং সুফি-সাধু সংগঠনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল।
এই অবস্থায় উদীয়মান মুসলিম গোষ্ঠীর অনেক উলামা ও ধর্মীয় নেতা ১৮শ শতাব্দীতে আরবে (বর্তমান সৌদি আরব) শুরু হওয়া শুদ্ধতাবাদী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহহাব, যিনি আরবের নজদ অঞ্চলে নিজের আন্দোলনকে প্রচার করতেন। তিনি ইসলাম থেকে বিভিন্ন প্রথা ও আচরণ দূর করার আহ্বান জানান, যেগুলোকে তিনি বিকৃতি বা ‘বিদআত’ হিসেবে গণ্য করতেন।
বাংলা অঞ্চলের দরিদ্র কৃষক পরিবারের এক মুসলিম পণ্ডিত হাজি শরীয়তুল্লাহ ১৭৯৯ সালে আরবে ভ্রমণ করেন এবং সেখানে অবস্থানকালে আল-ওহহাবের আন্দোলন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। ভারতে ফিরে এসে তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের রয়ে যাওয়া সংস্কৃতি ও কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি ভারতে মুসলমানদের পতনের মূল কারণ হিসেবে হিন্দুধর্ম থেকে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান গ্রহণ করার মাধ্যমে এখানকার মুসলমানগণের ইসলামের ভুল অনুশীলনকে দায়ী করেন। উপমহাদেশে জারি থাকা বিভিন্ন রসম-রেওয়াজ, যেগুলো হাজার বছর ধরে সুফিবাদ ও হিন্দুধর্মের মিশেলে জন্ম নিয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়, সেসবেরও কঠোর সমালোচনা করেন হাজী শরীয়তুল্লাহ।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হলো সৈয়দ আহমদ বেরেলভি। সুফিবাদের গভীর অনুসারী হলেও তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ভারতের সুফিবাদেও সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। তার মতে, এই সংস্কার সম্ভব শুধুমাত্র জনমানসে শরিয়াহ আইনের গুরুত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এটি ছিল ঐতিহাসিকভাবে ভারতের বৈচিত্র্যময় সুফি সম্প্রদায়ের জন্য এক ব্যতিক্রমী চিন্তা। কারণ এই অঞ্চলের সুফিবাদ মূলত ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল এবং এর চারপাশে, বিশেষ করে স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে গড়ে ওঠা বিভিন্ন আচার ও বিশ্বাসের ব্যাপারে উদার ছিল।
সৈয়দ আহমদ বেরেলভি ধারণা দেন যে, ভারতের সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের বিরুদ্ধে যে বিশ্বাস, তার ফলেই মুসলমানদের অবস্থার অবনতি ঘটেছে। তার মতে, শুধুমাত্র জিহাদের চর্চার মাধ্যমেই রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব, যে জিহাদের চেতনা উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। ফলে সৈয়দ বেরেলভি সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে একটি অনুসারী গোষ্ঠী গড়ে তোলেন এবং বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে একটি আন্দোলন শুরু করেন। সেই সময়ে এই অঞ্চল শিখ শাসনের অধীনে ছিল, যারা আওরঙ্গজেব শাসনের শেষ দিকে ক্ষমতায় এসেছিল।
সৈয়দ বেরেলভি এক হাজারের বেশি অনুসারী সংগ্রহ করেছিলেন, যাদের বেশিরভাগই ছিল বিভিন্ন পশতু গোত্রের সদস্য। তিনি তাদেরকে উপজাতীয় প্রথা ত্যাগ করে “অবিশ্বাসী” (শিখ ও ব্রিটিশ) শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ চালানোর আহ্বান জানান। তার লক্ষ্য ছিল শরিয়াহ আইন দ্বারা পরিচালিত একটি রাষ্ট্র কায়েম করা।
শিখদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধের পর সৈয়দ বেরেলভি এই অঞ্চলে একটি শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করতে সক্ষম হন। তিনি শরিয়াহর ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন শুরু করেন। তবে এই পদক্ষেপে অনেক উপজাতীয় নেতা নাখোশ হয়। তারা অভিযোগ করতে শুরু করে যে, তিনি তাদের দীর্ঘদিনের উপজাতীয় প্রথাকে উপেক্ষা করছেন।
যেসব গোষ্ঠী শুরুতে শিখদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে তাকে সহযোগিতা করেছিল, (শিখদের ইন্ধনে) ১৮৩০ সালে তাদের অনেকেই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে এবং (তার ২০০ অনুসারীকে হত্যা করার মাধ্যমে) আন্দোলনকে চারসাদার পাথুরে-পাহাড়ি অঞ্চলে পিছু হটতে বাধ্য করে। পরবর্তীতে ১৮৩১ সালে বালাকোট শহরে শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদের সময়ে সৈয়দ আহমদ বেরেলভি শিখ বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
ভারতে শরীয়তুল্লাহ এবং সৈয়দ আহমদের মতো ব্যক্তিত্বদের ইসলাম ও মুসলমানদের ‘শুদ্ধিকরণ’ (ব্যাপক দাওয়াত এবং জিহাদের মাধ্যমে) প্রকল্প ছিল মূলত স্থানীয় মুসলমানদের মনে গভীরভাবে গেঁথে থাকা আতঙ্কের প্রতিফলন। এই আতঙ্কের পেছনে কিছু নির্দিষ্ট কারণ ছিল। তৎকালীন হিন্দু সংস্কারবাদী আক্রমণাত্মক আন্দোলনের প্রসার ছিল এর অন্যতম কারণ। আরেকটি কারণ ছিল ব্রিটেন থেকে আসা খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যক্রম। তাছাড়া খ্রিস্টান মিশনারিরা নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং কিছু স্থানীয় মুসলমানের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছিল। হাজী শরীয়তুল্লাহ এবং সৈয়দ আহমদ বেরেলভি মনে করতেন, ভারতের সাধারণ মুসলমানদের বিশ্বাসের প্রকৃতি এমন যে, এরা সহজেই মিশনারি ও হিন্দু সংস্কারবাদীদের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
তাদের চিন্তা ছিল যে, কেবল ইসলামী আইন ও রীতিনীতির কঠোর অনুসরণই মুসলিম সম্প্রদায়কে পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে বিলীন হওয়া থেকে হেফাজত করতে পারবে। এরই ধারাবাহিকতায় শরীয়তুল্লাহ এবং সৈয়দ বেরেলভির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনগুলো মসজিদ ও মাদ্রাসাকে স্থানীয় মুসলমানদের জাতীয় চেতনার ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বস্তুত, এই আন্দোলনগুলো ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম জাতীয়তাবাদের সংগঠিত হবার একটি অধ্যায়।
তবে ব্রিটিশরা তাদের ক্ষমতা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করার সাথে সাথে এই আন্দোলনগুলো থেমে যায়। এসব আন্দোলন অনেক ভারতীয় মুসলমানের মধ্যে আবেগের জোয়ার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এই আবেগ (ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে) মুসলমানদেরকে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি; বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এই অবস্থা আরও প্রকট হয়।
আধুনিক ভারত ও পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে স্মরণীয় এই মহাবিদ্রোহ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কিছু হিন্দু ও মুসলিম সৈনিকের বিদ্রোহের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। তবে এর বেশিরভাগ বেসামরিক নেতা ছিলেন স্থানীয় মুসলমান সমাজ এবং অভিজাত মুসলিম শ্রেণির অবশিষ্ট অংশের লোকজন। কিন্তু (ঔপনিবেশিক ইংরেজরা প্রায় আট লক্ষ মানুষকে হত্যার মাধ্যমে) এই রক্তাক্ত বিদ্রোহ দমন করে এবং এর মাধ্যমে মুঘল শাসনের শেষ চিহ্নগুলোও সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করতে সমর্থ হয়।
এই বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর ব্রিটিশদের ক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশদের মতে, মুসলমানরাই এই বিদ্রোহে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। এর ফলে, উইলিয়াম মিউরের মতো প্রভাবশালী ব্রিটিশ লেখকেরা মুসলমানদের নিয়ে একটি মিথ প্রচার করতে থাকে। এই মিথে মুসলমানদের চিত্রায়িত করা হয় এক হাতে কোরআন এবং অন্য হাতে তলোয়ারধারী হিসেবে।
মুসলিম জাতীয়তাবাদ: যুক্তিবাদী অধ্যায়
একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের আগে ভারত নিয়ে ব্রিটিশদের লেখালেখিতে ভারতকে মূলত একটি একক জাতিসত্তা (racial whole) হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এই ধারণায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে ১৮৫৭ এর পর, যখন ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যকার ধর্মীয় পার্থক্যের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গতিবিধি তদন্ত করতে শুরু করে। তাদের গবেষণার ফলাফল দুই সম্প্রদায়ের ওপর ব্রিটিশদের আরো বেশি মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে ।
ফলশ্রুতিতে ইসলামী ইতিহাসকে খ্রিস্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার জন্য এবং ইসলামী ঐতিহ্যকে ধ্বংসাত্মক ও প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য ভারতীয় মুসলিম পণ্ডিতগণ ব্রিটিশ লেখকদের তীব্র সমালোচনা করতে শুরু করেন। তবে প্রথম মুসলিম পণ্ডিত যিনি এই বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া হাজির করেছিলেন, তিনি না উলামা মহল থেকে এসেছিলেন আর না তিনি কোনো ধর্মীয় নেতা ছিলেন। তিনি এসেছিলেন এক পুরনো সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার থেকে। তার নাম ছিল স্যার সৈয়দ আহমদ খান।
আর সৈয়দ আহমদ খানের হাত ধরেই ভারতে মুসলিম জাতীয়তাবাদের দ্বিতীয় এবং অধিক প্রভাবশালী ধারা বা অধ্যায় শুরু হয়। এটি ছিল সেই অধ্যায়, যেখানে এটি উপমহাদেশে একটি পৃথক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের ধারণার স্বপক্ষে একটি আন্দোলনে পরিণত হয় এবং পরে তা পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ রূপে বিকশিত হয়।
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময় স্যার সৈয়দ ইতোমধ্যেই নিজেকে একজন পণ্ডিত ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি সুফিবাদ, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং ঐতিহ্যবাহী ইসলামী জ্ঞানতত্ত্বে বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। ইংরেজ কর্তৃক বিদ্রোহ দমন হওয়ার পরপর যখন ইসলামের ইতিহাসের উপর সমালোচনামূলক সাহিত্য বের হতে শুরু করেছিল, সৈয়দ আহমদ খান তখন একটি বিস্তারিত প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি আশা করেছিলেন, এটি নিছক ব্রিটিশদের তৈরি করা ইসলামের ধারণাকে খণ্ডনই করবে না, বরং মুসলিম সমাজের বিশ্বাস, চরিত্র এবং অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করতে সাহায্য করবে—যা তখনকার পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।
খান ব্রিটিশদের মনে করিয়ে দিলেন যে, ইসলাম প্রকৃতপক্ষে একটি অগ্রসর ও আধুনিক ধর্ম, যা বিশ্বজুড়ে অনেকগুলো বৃহত্তম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রেরণা দিয়েছিল। সেইসব মুসলিম সাম্রাজ্যগুলো সেসময় দর্শন ও বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতা করতো, যখন ইউরোপ ‘অন্ধকার যুগে’ দিশাহীনভাবে পথ খুঁজছিল। সৈয়দ খান আরও দাবি করলেন যে, পশ্চিমের বৈজ্ঞানিক ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব মূলত মধ্যযুগীয় মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের গবেষণামূলক প্রচেষ্টার দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত হয়েছিল। কিন্তু মুসলিমরা পরবর্তীতে পিছিয়ে পড়েছিল, কারণ তারা ইসলামের এই দিকটি আর চর্চা করেনি। মজার বিষয় হলো, সৈয়দ আহমদ খানের মতো ব্যক্তিদের দ্বারা উনিশ শতকে প্রবর্তিত এই তত্ত্বটি এখনও বিশ্বের অনেক মুসলিমের মধ্যে প্রচলিত।
এরপর সৈয়দ খান নিজের সম্প্রদায়ের দিকে মনোযোগ দেন। (একজন আধুনিকতাবাদী মুসলিম এবং ব্রিটিশদের অনুগত হিসেবে) তিনি শরীয়তুল্লাহ এবং সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর মতো ব্যক্তিদের কট্টরপন্থী আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করেন। (ব্রিটিশ সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায়ে আগ্রহী সৈয়দ খান) ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহেরও সমালোচনা করেন। তার মতে, এমন উদ্যোগগুলো ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর। তবে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের জন্য একমাত্র মুসলমানরাই দায়ী ছিল, ব্রিটিশদের এমন ধারণার সাথেও তিনি একমত ছিলেন না। বরং তিনি লিখেছিলেন যে, এই বিদ্রোহ ব্রিটিশদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের ফলাফল, যা ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে তাদের ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে ঘটেছিল।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আয়েশা জালালের মতে, মুসলিম এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণা মোটাদাগে ব্রিটিশদের সামাজিক প্রকৌশলের ফল, যা তারা ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর একটি প্রকল্প হিসেবে শুরু করেছিল। এই প্রকল্প শুরু হয়েছিল ব্রিটিশদের আদমশুমারি ধারণা প্রবর্তনের মাধ্যমে। এই শুমারিতে ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাসের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল এবং আদমশুমারির ফলাফলে মানুষকে তার অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থানের বদলে ধর্মের ভিত্তিতে বেশি ভাগ করা হয়েছিল।
ফলস্বরূপ ধর্মবিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে কিছুটা কৃত্রিমভাবে সম্প্রদায়কেন্দ্রিক ধারণা গড়ে ওঠে। এই আদমশুমারি কেবল ভারতীয় সমাজের জটিল প্রকৃতি বোঝার জন্যই করা হয়নি, বরং ভারতীয়দেকে আরও বেশি মাত্রায় নিয়ন্ত্রণের জন্য কাঠামোগত উপায় খুঁজে বের করাও ছিল এর অন্যতম লক্ষ্য। সৈয়দ খান দ্রুতই এটি বুঝতে পেরেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি এটিও উপলব্ধি করেছিলেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় তাদের বৃহৎ জনসংখ্যা এবং ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর ব্রিটিশদের সাথে তুলনামূলক ভালো সম্পর্কের কারণে নিজেদের একটি সামগ্রিক সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে তুলতে অধিকতর সক্ষম। সৈয়দ খান তার তত্ত্বে সঠিকভাবে উল্লেখ করেছিলেন যে, মুসলিমদেরও নিজেদেরকে একটি সামগ্রিক সম্প্রদায় হিসেবে সংগঠিত এবং আত্মপ্রকাশ করতে হবে। বিশেষত এটিকে হতে হবে এমন একটি সম্প্রদায়, যা ভারতের সামাজিক, বিচারিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা যে পরিবর্তনগুলো আনছিল তার প্রতি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে সক্ষম।
এটি শরীয়তুল্লাহ এবং সৈয়দ আহমদ বেরেলভির মতো ব্যক্তিদের সংগঠিত মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক ধারণা থেকে অনেকটা ভিন্ন ছিল। ভারতে তাদের মুসলিম সম্প্রদায় গঠনের ধারণাটি ছিল নিছকই ধর্মীয় একটি প্রচেষ্টা। তাদের চেষ্টা ছিল ভারতে একটি সমজাতীয় মুসলিম সম্প্রদায় গড়ে তোলা, যারা একটি সমন্বিত মুসলিম আচার ও বিশ্বাস অনুসরণ করবে। তবে ওই অঞ্চলের মুসলিম সম্প্রদায়গুলোর ভেতরে স্পষ্ট মতাদর্শগত, শ্রেণিগত, জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক বিভাজনের ফলে এই প্রকল্পটি মোটাদাগে ব্যর্থ হয়েছিল। সৈয়দ আহমদ খান এই বিভাজন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং এটি মোকাবিলা করতে ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের ধারণাকে স্থানীয়ভাবে প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন।
যখন ব্রিটিশরা অর্থনৈতিক, জাতিগত এবং সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় গোষ্ঠীগুলিকে একত্রিত করে ধর্মের ভিত্তিতে মুসলিম, হিন্দু এবং শিখ সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করেছিল, তখন এই সম্প্রদায়গুলোর সংস্কারকগণ সেই সুযোগকে লুফে নেন। তারা ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশদের তৈরি সম্প্রদায় সংগঠন (community-formation) প্রকল্পের অন্তর্নিহিত বিরোধ তথা আন্ত-গোষ্ঠীয় বিরোধগুলোকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেন।
তবে এটি করা যতটা সহজ মনে হয়েছিল, বাস্তবে ততটা সহজ ছিল না। জাতীয়তাবাদ ছিল একটি আধুনিক ইউরোপীয় ধারণা, যার মাধ্যমে কোন জনগোষ্ঠী ইতিহাস, সমাজ এবং রাজনীতির একটি নির্দিষ্ট বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে একটি সম্মিলিত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ব্রিটিশদের আগমনের আগে ভারতে এই ধারণার অস্তিত্ব ছিল না। মুসলিম শাসনের পতন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীয়তুল্লাহ এবং সৈয়দ আহমদের মতো ব্যক্তিত্বরা ভারতের মুসলমানদের এমন একটি সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন, যারা ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায় তথা উম্মাহ’র সাথে সামঞ্জস্য রাখবে।
মুসলিম শাসনের শেষ দিনগুলোতে, ভারতের মসজিদগুলোতে আলেমগণ তাদের খুতবায় মুঘল সুলতানদের নাম বাদ দিয়ে উসমানী খলীফাগণের নাম উল্লেখ করতে শুরু করেন। এর মাধ্যমে বোঝানো হতো যে, ভারতের মুসলমানদের স্বার্থ বৃহত্তর মুসলিম শক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বস্তুত উলামাগণ ভারতের মুসলমানদের একটি ঐক্যবদ্ধ সামগ্রিক সম্প্রদায় হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করেছিলেন। এই ঐক্যবদ্ধ সম্প্রদায়ের ধারণাটি আধুনিক জাতীয়তাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে নয়, বরং বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল।
কিন্তু আধুনিকতাবাদী সৈয়দ খান এই পদ্ধতিতে সমস্যা দেখেছিলেন। তার মতে, এই দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাসের পরিবর্তনশীল ধারার বিপরীত। তিনি তিনটি প্রধান মানসিক নেতিবাচকতার বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন, যা তার মতে মুসলমানদের মনোভাবের মধ্যে প্রবেশ করে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছিল এবং তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। এই নেতিবাচক মানসিকতা তিনটি ছিল—বিলাসিতা, অতীতপূজা, এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি।
সৈয়দ খান লিখেছিলেন, সাম্রাজ্যে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছানোর পর মুসলমানরা বিলাসিতায় মত্ত হয়ে অলস হয়ে পড়েছিল। এই অলসতার ফলে ধীরে ধীরে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা হারায়, আর ফলস্বরূপ তারা অতীতের গৌরব নিয়ে অতিরিক্ত স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। এই স্মৃতিকাতরতা আবার তাদের মধ্যে একধরনের হীনমন্যতাবোধকে দৃঢ় করে তোলে, যে হীনমন্যতাবোধ পশ্চিমের উত্থানের বিপরীতে তাদের বর্তমান দুর্দশা বিবেচনা করে আরও গভীর হয়। আর এর ফলে আধুনিকতা ও পরিবর্তনের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কঠোর হয়ে ওঠে এবং গোঁড়া মানসিকতা জন্ম নেয়।
তার মতে, ভারতের মুসলমানরা স্থবির হয়ে গিয়েছিল, অগ্রসর হতে অস্বীকার করছিল। তারা মনে করত তাদের বিরুদ্ধে একটি বৃহৎ ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। অথচ তিনি মনে করতেন, মুসলমানরা রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়েছে কারণ তারা শাসনের যোগ্যতা হারিয়েছিল। তিনি উলামাদের সমালোচনা করেছিলেন, কারণ তারা মুসলমানদের বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে ঠেলে দিচ্ছিল এই বলে যে বিজ্ঞান হচ্ছে “পশ্চিমা”। তিনি সতর্ক করেছিলেন যে, বিজ্ঞানের প্রতি এমন মনোভাব মুসলমানদের একদিকে কুসংস্কারের ভারে এবং অন্যদিকে গোঁড়ামির চাপে চিরকাল দমিয়ে রাখবে।
এদিকে উলামারা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলো যে, যখন তারা মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছে, তখন তিনি তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছেন। প্রত্যুত্তরে তিনি লিখলেন, একজন সংস্কারক হিসেবে তার কাজ ঐক্য স্থাপন নয়, বরং তার সম্প্রদায়ের সদস্যদের চেতনাকে নাড়িয়ে দেওয়া এবং প্রতিষ্ঠিত কিন্তু ক্ষতিকারক সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক নিয়মগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। তিনি উলামাদের প্রশ্ন করলেন—
“গ্রীকরা মিশরীয়দের কাছ থেকে শিখেছে; মুসলমানরা গ্রিকদের কাছ থেকে শিখেছে; ইউরোপীয়রা মুসলমানদের কাছ থেকে শিখেছে ..., তাহলে মুসলমানরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে শিখলে কী মহাবিপদ নেমে আসবে?”
তিনি ইতিহাসের একটি বিবর্তনবাদী মডেল ব্যবহার করে দেখিয়েছিলেন—কীভাবে জ্ঞান এক সভ্যতা থেকে অন্য সভ্যতায় প্রবাহিত হয়। কিন্তু তার অধিকাংশ প্রথাগত সমালোচকের কাছে ইতিহাস ছিল এমন একটি ঐতিহ্য, যা একজন মুসলিম পণ্ডিত থেকে আরেকজনের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে এবং উলামাদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
সৈয়দ আহমদ খানের প্রাথমিক কাজগুলো ছিল বিশ্লেষণধর্মী ও শিক্ষামূলক। অন্যদের মতো মসজিদ ও মাদ্রাসার মতো শক্তিশালী কোনো প্ল্যাটফর্ম তার ছিল না; কিন্তু এতে তিনি বিচলিত হননি। বরং তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ব্রিটিশ শাসনের অধীনে পরিবর্তিত বাস্তবতা মুসলমানদের ওপর এমন প্রভাব ফেলবে, যার ফলে তাদের অনেকেই তার দৃষ্টিভঙ্গির কদর বুঝতে শুরু করবে। তিনি চেয়েছিলেন, মুসলমানরা তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক স্থবিরতা কাটিয়ে উঠুক এবং বর্তমান বাস্তবতা অর্থাৎ আধুনিক শিক্ষাকে গ্রহণ করুক।
উলামা ও তার মধ্যে কোনো মতৈক্যের সুযোগ ছিল না, কারণ উভয়েই ভারতের মুসলিম পরিস্থিতিকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছিলেন। তবে সৈয়দ আধুনিকতার ধর্মতাত্ত্বিক সমালোচনা করার মাধ্যমে তাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন । তিনি লিখেছিলেন, একজন মানুষের আত্মিক ও নৈতিক জীবন তখনই উন্নত হতে পারে, যখন তার পার্থিব জীবন বিকশিত হয়। ১৮৭০ সালে তার প্রতিষ্ঠিত একটি জার্নালে লিখে তিনি তার সমালোচকদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, মুসলমানরা একসময় (৯ম থেকে ১৩শ শতাব্দী পর্যন্ত) বিজ্ঞানচর্চার উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক ছিল। এছাড়া আল্লাহ কুরআনে মানুষকে তাঁর অন্যতম মহান সৃষ্টি “বিশ্বজাহান নিয়ে গবেষণা” করতে উৎসাহিত করেছেন।
ইসলামকে অন্তর্নিহিতভাবে প্রগতিশীল এবং মূলত কালোত্তীর্ণ (অর্থাৎ পরিবর্তনশীল সময়ের সাথে সহজে মানিয়ে নিতে সক্ষম) প্রমাণ করার জন্য সৈয়দ আহমদ খান কুরআনের উপর একটি সুসংগঠিত গবেষণা ও বিশদ তাফসীর রচনা করেন। তার ‘তাফসীরে কুরআন ’ ১৮৮০ সালে প্রকাশিত হয় এবং এটি ছিল সেই সময়ে কুরআনের একটি মৌলিক ও সাহসী ব্যাখ্যা। কারণ এটি ইসলামের পবিত্র গ্রন্থের বিষয়বস্তুকে ১৯শ শতকের আলোকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিল।
খান জোর দিয়ে বলেছিলেন, আগেকার উলামাদের দেওয়া ফতোয়াগুলো ছিল নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক এবং সেগুলো বর্তমানে প্রচলিত ভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। তিনি লিখেছিলেন যে মুসলমানদের প্রয়োজন “ইসলামের এক নতুন ধর্মতত্ত্ব” (a new theology of Islam), যা হবে যুক্তিনির্ভর এবং তা এমন সব প্রথাগত মতবাদ প্রত্যাখ্যান করবে, যা সাধারণ জ্ঞান, যুক্তি এবং কুরআনের মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক।
তিনি লিখেছিলেন যে “বিশ্বাসের নিয়ম” (codes of belief) এবং রূহানিয়াতই ধর্মের মূল বিষয়; আর খাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অভ্যাস হলো সাধারণ বিষয়, যেগুলো সময় ও স্থান অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। ইসলাম এই ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নৈতিক নির্দেশনা প্রদান করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, যদি বিশ্বাসকে যুক্তি ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে চর্চা না করা হয়, তাহলে তা কখনোই প্রকৃত বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে পালন করা সম্ভব নয়।
তিনি লিখেছিলেন যে, ধ্রুপদী ইসলামী পণ্ডিতরা ভুলের উর্ধ্বে ছিলেন না। তিনি জোর দিয়ে বিশ্বাস করতেন যে, বর্তমান উলামারা ধ্রুপদী পণ্ডিতদের চিন্তাভাবনা থেকে অন্ধভাবে ধার করেই তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইসলামের ধারণা তৈরি করছেন। তার মতে, এর ফলে তারা চিন্তার গোঁড়ামিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন এবং আশেপাশে ঘটে যাওয়া ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রতিও বিরূপ মনোভাব পোষণ করছেন।
আফগানীর প্যান-ইসলামিজম
১৯ শতকে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে আরেকটি আধুনিকতাবাদী প্রবণতা ছিল প্যান-ইসলামিজম, যার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন জামাল উদ্দীন আল-আফগানী। তিনি ১৮৫৫ সালে ভারতে আসেন এবং একজন মেধাবী আফগান ভাবাদর্শী (ideologist) হিসেবে দ্রুত পরিচিতি লাভ করেন।
আফগানী ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহকে উষ্ণভাবে সমর্থন করেছিলেন এবং এর ব্যর্থতায় হতাশ হয়েছিলেন। তবে ঐতিহ্যবাহী উলামাদের মতো তিনি ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত আধুনিকতাকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে অন্তর্মুখী হওয়াকে ভালো কিছু মনে করেননি। তিনি “পশ্চিমা শিক্ষার” শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকার করেছিলেন। তবে জোর দিয়েছিলেন যে, মুসলিমদের এটি গ্রহণ করা উচিত তাদের অবস্থার উন্নতি করার জন্য, যাতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিহত করে একটি বৈশ্বিক ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা যায়।
সৈয়দ আহমদ খানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুসলিম আধুনিকতাবাদের চেয়ে আফগানী এবং তার পরবর্তী প্যান-ইসলামিজমের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। তারা পশ্চিমা আধুনিকতাকে (বিশেষত শিক্ষার ক্ষেত্রে) মুসলমানদের পুনর্জীবনের মাধ্যম হিসেবে দেখেছিল। তবে তাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধু উপনিবেশিক ব্যবস্থার মধ্যে নিজেদের স্থান তৈরি করা নয়, বরং পুরোপুরি উপনিবেশবাদকে বোঝা এবং সেটিকে নির্মূল করা। অন্যদিকে খানের মুসলিম আধুনিকতাবাদ মূলত ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আগ্রহী ছিল। তার ধারণা ছিল, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আফগানীর কঠোর অবস্থান ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের মতোই মুসলিমদের জন্য হতাশাজনক পরিণতি বয়ে আনবে।
আফগানী আহমদ খানের সমালোচনা করেছিলেন এ কারণে যে, তিনি শুধুমাত্র ভারতের মুসলিমদের নিয়ে কথা বলে উম্মাহর স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্থ করছিলেন এবং এমন একটি ধারণা তৈরি করেছিলেন যেন ভারতের মুসলিমরা বিশ্বব্যাপী অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায় বা উম্মাহ থেকে আলাদা। এছাড়া আফগানী গোঁড়া উলামাদেরও সমালোচনা করেছিলেন, যারা আধুনিক শিক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তবে উলামাদের মতো তিনিও মুসলিমদের একটি বৈশ্বিক সম্প্রদায় (উম্মাহ) হিসেবে দেখতেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে প্যান-ইসলামিজম ছিল মূলত জাতীয়তাবাদ-বিরোধী (anti-nationalist) প্রকল্প।
তবে আফগানী ছিলেন তুলনামূলক প্রগতিশীল এবং আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ। ইসলামকে তিনি কেবল একটি ধর্মীয় বিপ্লবের পথ হিসেবে দেখেননি; বরং এটিকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের একত্রিত করার স্লোগান হিসেবে দেখেছিলেন। আফগানী যে প্যান-ইসলামিজমের ধারণা চালু করেছিলেন, তা আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থায় মুসলিম মানসের সংস্কারকে গুরুত্ব দিয়েছিল এবং সেই পরিমার্জিত মানসকে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ইস্তেমাল করায় জোর দিয়েছিল। তবে পরবর্তী শতকে ক্রমবিকাশমান প্যান-ইসলামিজমের ভিন্ন ধারায় তার প্রাথমিক ধারণাটির কাঠামোই কেবল অবশিষ্ট ছিল।
সৈয়দ আহমদ খান প্যান-ইসলামিজমের ধারণার বিরোধিতা করেছিলেন, কারণ সম্ভবত তিনি বুঝেছিলেন যে এটি এমন এক পথে বিকশিত হবে, যা মূল সংস্কারমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে কল্পনাপ্রসূত অতীতের প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে?
মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিজয়
১৮৭৯ সালে খানের একজন ঘনিষ্ঠ সমর্থক, কবি ও বুদ্ধিজীবী আলতাফ হোসেন হালি একটি দীর্ঘ কবিতা লিখেন, যেখানে খানের সংস্কার ও আধুনিকতার ধারণাগুলো গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল। তবে কবিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি ছিল—হালি’র ভারতের অন্যান্য সম্প্রদায়, বিশেষত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে ভারতের মুসলিমদেরকে একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সত্তা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া। তবে হালি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, এই আলাদা অবস্থান কোনও ধরনের শত্রুতা বা বিদ্বেষের ভিত্তিতে ছিল না। বরং এটি ছিল এই বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে যে, ভারতের মুসলিমরা মূলত বিদেশি আগন্তকের বংশধর, যারা মুসলিম শাসনের সময় এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
১৯ শতকের শেষের দিকে, ভারতের অনেক মুসলিম নিজেদের পার্সিয়ান, মধ্য এশীয় বা আরবীয় বংশধর বলে দাবি করতে শুরু করেছিলেন। এর একটি কারণ ছিল মুসলিম শাসনের অবসানের পরও মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম সাম্রাজ্য টিকে থাকা। বিদেশি বংশধর হওয়ার দাবিটি ছিল ভারতের মুসলিমদের স্বতন্ত্রতা প্রকাশের একটি উপায়।
এই প্রেক্ষাপটে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল উর্দু ভাষার উত্থান। যদিও পার্সিয়ান, মধ্য এশীয় ও আরব বংশধর বলে দাবি করা একটি গর্বের বিষয় ছিল; তবুও ভারতের উত্তর অঞ্চলের “নিম্নবর্গের মুসলিমদের” ভাষা হিসেবে উর্দু দ্রুতই একটি জটিল সাহিত্যিক ভাষায় পরিণত হয়। তবে ব্রিটিশদের এতে কোনও সমস্যা ছিল না। কারণ মুসলিম শাসনের সময় রাজদরবারের ভাষা ছিল ফার্সি। ফলে ফার্সি হারিয়ে যাওয়া মানে ছিল ভারতের মুসলিম শাসনের স্মৃতি ও প্রভাব অনেকটা হ্রাস পাওয়া।
১৮৩৭ সালে ব্রিটিশরা আনুষ্ঠানিকভাবে ফার্সির পরিবর্তে উর্দুকে ভারতের উত্তরাঞ্চলের স্বীকৃত আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। তবে ১৮৬০-এর দশকে উর্দু মুসলিমদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে। তবে এটি যতটা না মুসলিমদের প্রচেষ্টার কারণে হয়েছিল, তারচেয়ে বরং উর্দুকে আনুষ্ঠানিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার বিষয়ে হিন্দুদের প্রতিক্রিয়ার কারণেই সম্ভব হয়েছিল। হিন্দুদের আপত্তির কারণে সৃষ্ট বিতর্ক উর্দুকে মুসলিমদের জন্য একটি স্বতন্ত্র চিহ্ন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, যা মুসলিমদেরকে হিন্দুদের থেকে আরও আলাদা করে তুলেছিল।
এ অবস্থায় সৈয়দ আহমদ খানের মুসলিম জাতীয়তবাদী চিন্তা ক্রমবর্ধমান তরুণ বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক, কবিদের সমর্থন লাভ করে এবং প্রশংসিত হয়। তবে তাকে অনেক তীব্র ও আক্রমণাত্মক সমালোচনাও মোকাবিলা করতে হয়েছিল। রক্ষণশীল উলামারা সৈয়দ আহমদ খানের অত্যন্ত কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন তাকে মুরতাদ বলেও অভিযুক্ত করেন। তারা তাকে ইসলাম ধর্মের অপরিবর্তনীয় মূলনীতি থেকে মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা এবং বিশ্বাসীদের মধ্যে “আংগ্রেজিয়াত” বা পশ্চিমা নীতি ও রীতি প্রচার করার অভিযোগে দোষারোপ করেন।
আফগানীর প্যান-ইসলামিজমের সমর্থকরাও সৈয়দের সমালোচনা করেছিলেন। আফগানী নিজেও খানকে ভর্ৎসনা করেন। তিনি একদিকে খানকে শুধু ভারতের মুসলিমদের প্রেক্ষাপটে মুসলিম জাতীয়তাবাদের কথা বলে বৈশ্বিক মুসলিম ঐক্যের ধারণাকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য দোষারোপ করেন, অন্যদিকে তিনি তাকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ক্ষতি করার জন্যও অভিযুক্ত করেন। আফগানীর মতে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানাতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভারতজুড়ে ছাপাখানার প্রসারের ফলে গড়ে ওঠা অসংখ্য উর্দু সংবাদপত্রের মাধ্যমে বিবৃতি, সম্পাদকীয় এবং প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত হওয়া এইসব সমালোচনা সত্ত্বেও সৈয়দ আহমদ খানের ধারণাগুলো পরবর্তীতে ভারতের মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রধান ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আয়েশা জালালের মতে, ব্রিটিশদের সাথে সৈয়দ আহমদ খানের কৌশলগত ও বাস্তববাদী অবস্থান তার ধারণাগুলোকে আরও সংগঠিত ও মুক্তভাবে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছিল। বিপরীতে তার বিরোধীদের সমালোচনাগুলো খুব একটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেনি।
এসবের ধারাবাহিকতায় খানের ধর্মীয় বিরোধীদের বেশিরভাগই আলীগড়ে তার প্রতিষ্ঠিত স্কুলে কোনো স্থান পাননি। এই স্কুল পরে একটি কলেজে পরিণত হয় এবং এরপর একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠে, যা একটি বিশেষ ধরনের মুসলিম অভিজাত ও শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করতে শুরু করে। এই শ্রেণিই পরবর্তীতে ভারতের মুসলিম জাতীয়তাবাদী চিন্তার ধারা সুসংহত করে এবং এর ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করে।
হদিস
• Mubarak Ali: Pakistan in Search of Identity (Aakar Books, 2011)
• Not a camp language: Urdu’s origins (DAWN, July 5, 2015)
• Hans Dua: Pluricentric Languages (Walter de Gruyter, 1992)
• Tariq Rehman: From Hindi to Urdu (Oxford University Press, 2013)
• Simon Ross Valentine: Force and Fanaticism (Oxford University Press, 2014)
• Razia Aktar Banu: Islam in Bangladesh (BRILL, 1992)
• Entry on Shariatullah by Moinuddin Ahmad in National Encyclopedia of Bangladesh (2012)
• Edward Mortimer: Faith and Power (Random House, 1982)
• Qeyamuddin Ahmad: The Wahhabi Movement in India (South Asia Books, 1994) p.50
• Thomas R. Metcalf: The Aftermath of Revolt (Princeton, 1965)
• H. Hardy: Muslims of British India (Cambridge University Press)
• Edward Said: Orientalism (Penguin Books, 2006)
• Wilferd Smith: Modern Islam in India (1943)
• Sir Syed Ahmad Khan: Asbab-e-Baghawat-e-Hind (First published in 1859)
• Ayesha Jalal: Self and Sovereignty (Sang-e-Meel Publications, 2001)
• Tahir Abbas: Islamic Radicalism and Multicultural Politics (Taylor & Francis, 2011)
(তরজমা করেছেন হাসান আব্দুল্লাহ।)