
হক আর বাতিল চিনব কীভাবে?
(আমাদের বয়স বেড়ে চলছে৷ প্রতিনিয়তই আমরা নতুন নতুন চিন্তার সাথে পরিচিত হচ্ছি। এসব চিন্তার মাঝে কিছু চিন্তা আছে উপকারী, আর কিছু অপকারী। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে— আকল তথা বিবেক-বুদ্ধির সাহায্যে উপকারী চিন্তাগুলোকে বেছে নেওয়া। অতীত হচ্ছে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষক। অতীতের ভুল থেকেই আমরা শিখি। আর, বর্তমান তো আমাদের হাতেই। বর্তমানের ওপর নির্ভর করে আমাদের ভবিষ্যত। তাই, এই বর্তমানের গলায় পরাতে হবে উপকারী চিন্তাগুচ্ছের মালা।)
হক আর বাতিল চিনার উপায় কী? কীভাবে আমরা হক আর বাতিলের মাঝে তফাত করব?
সাইয়িদুনা আলি রাযি. বলেন—
لا تعرف الحق بالرجال اعرف الحق تعرف أهله
“ব্যক্তির মাধ্যমে হক চিনতে যেও না। বরং, হক চিনো, হকপন্থীদের এমনিতেই চিনে যাবে।”
হক আর বাতিল চিনার ক্ষেত্রে এই মূলনীতিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো আলেম বা শাসক কি বলেছে, কি করেছে তার ভিত্তিতে হক আর বাতিল নির্ধারিত হয় না। বরং, হক আর বাতিল নির্ধারণ করার কিছু মানদণ্ড আছে। এই মানদণ্ডগুলোর ওপর ভিত্তি করেই কেবল আমরা বলতে পারি— অমুক হকের ওপর আছে কিংবা অমুক বাতিলের ওপর আছে।
বলা হয়, হক হচ্ছে নুর বা আলো আর বাতিল হচ্ছে অন্ধকার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই নুর কার জন্য? এই নুর হচ্ছে ওই ব্যক্তিদের জন্য যাদের অন্তর্দৃষ্টি আছে, সুস্থ আকল আছে। তারাই কেবল হক নামক এই নুরের অধিকারী হতে পারবে। আর অবশ্যই, আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমেই এই অন্তর্দৃষ্টি বৃদ্ধি পায়। কারণ, আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্কই সকল কিছুর মূল। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন—
وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ وَيُعَلِّمُكُمُ اللَّهُ
“আর আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহ তোমাদের শিখাবেন।” সূরা বাকারা : ২৮২
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন—
وَالَّذِينَ اهْتَدَوْا زَادَهُمْ هُدًى
“যারা সৎপথ অবলম্বন করে, তাদেরকে আল্লাহ সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেন।” সূরা মুহাম্মাদ : ১৭
فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ ۚ
“অতঃপর তারা যখন বক্রপথ অবলম্বন করল, তখন আল্লাহ তাদের হৃদয়কে বক্র করে দিলেন।” সূরা সফ : ০১
এই ছোট্ট ভূমিকার পর আমরা বলতে চাই, হক আর বাতিল চিনার চারটি মানদণ্ড আছে। হক আর বাতিল চিনার ক্ষেত্রে এই চারটি মানদণ্ডকে ক্রমধারার ভিত্তিতে অনুসরণ করতে হবে। এই মানদণ্ডগুলো হচ্ছে—
১. শরিয়ত: হক আর বাতিল চিনার সর্বপ্রথম মানদণ্ড হচ্ছে শরিয়ত। শরিয়ত বলতে মূলত আমরা বোঝাচ্ছি—
ক. আল কুরআনুল কারিম। অর্থাৎ আমরা বলতে চাচ্ছি, নির্ভরযোগ্য আলেমদের তাফসির নির্ভর “আল কুরআনুল কারিম” এর আয়াতগুলো হচ্ছে শরিয়তের প্রথম উৎস; বিশেষত তারা যখন কোনো ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেন। নির্ভরযোগ্য আলেম বলতে আমরা এখানে তাদের কথাই বলছি, যাদের ব্যাপারে সমগ্র উম্মাহ একমত।
খ. মহানবির সুন্নাহ। অর্থাৎ আমরা বলতে চাচ্ছি, বড়ো বড়ো আলেমরা যেই সকল সুন্নাহকে সহিহ সাব্যস্ত করেছেন, সেগুলো হচ্ছে শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস। সুন্নাহ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আলেমদের অনেক বড়ো অবদান রয়েছে। প্রতিটি রাবির ব্যাপারে, প্রতিটি রিওয়ায়াতের ব্যাপারে আলেমরা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যালোচনা করে সুন্নাহর বিশুদ্ধতাকে ধরে রেখেছেন। আমাদের উচিত, আলেমদের এই মহান অবদানকে স্বীকার করা, সম্মান করা।
আল্লাহর রাসূল আমাদের যা দিয়ে গেছেন, তা গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন—
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ
“আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ করো।”
আল্লাহর রাসূল সা. তো এই সুন্নাহই আমাদেরকে দিয়ে গেছেন। তিনি আমাদেরকে কেবল কুরআন দিয়ে যান নি, বরং কুরআনের পাশাপাশি সুন্নাহও দিয়ে গেছেন। রাসূল সা. বলেছেন—
أَلَا إِنِّي أُوتِيتُ الْقُرْآنَ، وَمِثْلَهُ مَعَهُ.
“জেনে রাখ, আমাকে কুরআন দেওয়া হয়েছে এবং তার সাথে অনুরূপ কিছুও (অর্থাৎ সুন্নাহ) দেওয়া হয়েছে।” নাইলুল আওতার : ৮/২৭৮
অতএব, আমাদেরকে বিশুদ্ধ ব্যাখ্যানির্ভর সহিহ সুন্নাহ গ্রহণ করতে হবে। কোনো ব্যাখ্যা বিশুদ্ধ কিনা এটা আমরা কীভাবে বুঝতে পারব? কোনো ব্যাখ্যা বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য অবশ্যই এটাকে আরবি ভাষার নিয়ম-রীতির সাথে মিল রাখতে হবে। বর্তমান সময়ে আমরা এমন বহু লোককে দেখি, যারা তাদের বিবেকপ্রসূত চিন্তার আলোকে এমনভাবে সুন্নাহর ব্যাখ্যা করে, যার সাথে আরবি ভাষার নিয়ম-রীতির কোনোই মিল নেই।
অতএব, কোনো বিষয় হক না বাতিল এ ব্যাপারে জানতে হলে, প্রথমত এই বিষয়টাকে আমরা শরিয়তের মানদণ্ডের সাথে মিলিয়ে দেখব। যদি শরিয়তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহলে আমরা এটাকে হক বলে মেনে নিব। আর যদি শরিয়তে এ ব্যাপারে কোনো সমাধান না পাওয়া যায় কিংবা আলেমরা এ ব্যাপারে মতবিরোধ করে, তখন আমরা কী করব? আমরা তখন দ্বিতীয় মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিষয়টি বিবেচনা করব।
২. আকল: হক আর বাতিল চেনার দ্বিতীয় মানদণ্ড হচ্ছে আকল। আকলকে অনেকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করে থাকেন—
“মন্দ বিষয় থেকে ভালো বিষয় পৃথক করার নামই হচ্ছে আকল।”
বর্তমান যুগের পরিভাষার আলোকে আকলকে আমরা “আল মানতিকুস সহিহ” বা “বিশুদ্ধ মানতিক” নামে অভিহিত করতে পারি। তাই, হক চিনতে আমরা বিশুদ্ধ মানতিক ব্যবহার করতেই পারি। বিশুদ্ধ মানতিক অবশ্যই জ্ঞানের একটি শাখা, যদিও বহু লোক নিজস্বার্থে এর অপব্যবহার করে থাকে। কিন্তু আমরা যদি মানতিকের মূল “আল মানতিকুর রিয়াদি” তথা “Arithmetic Logic” এর দিকে ফিরে যাই, তাহলে এই অপব্যবহার অনেকাংশেই রোধ করতে পারব। কারণ যারা Arithmetic Logic সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে, তারা বিশুদ্ধ মানতিক সম্পর্কে অবগত থাকে। তাই, কোনো বিষয় হক না বাতিল তা জানতে বিষয়টিকে আমরা (যদি শরিয়তে এর সমাধান না পাওয়া যায়, তাহলে) আকলের মানদণ্ডের সামনে রাখব। আমরা দেখব আকল বিষয়টি সম্পর্কে কী বলে, কী সিদ্ধান্ত দেয়?
তবে এ কথা সত্য যে, আকলের এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও মাঝে মাঝে মতবিরোধ সৃষ্টি হতে পারে কিংবা আকলও বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশার মাঝে পড়তে পারে। তখন আমরা কী করব? আমরা তখন তৃতীয় মানদণ্ডের শরণাপন্ন হবো।
৩. সামাজিক প্রচলন: হক আর বাতিল চিনার তৃতীয় মানদণ্ড হচ্ছে সামাজিক উরফ বা সামাজিক প্রচলন। এই উরফ বলতে আমরা সমাজের সৎলোকদের মাঝে প্রচলিত রীতিনীতিকে বোঝাচ্ছি। তবে, এই উরফ হক আর বাতিল চিনার মানদণ্ড হিসেবে গৃহীত হতে হলে কোনোভাবেই তা শরিয়ত ও আকলের বিরোধী হতে পারবে না।
উরফ এর সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে ইমাম আল জুরজানি বলেন—
ما استقرت النفوس عليه بشهادة العقول وتلقته الطبائع بالقبول
“আকলের সাক্ষীর ভিত্তিতে হৃদয় যার ওপর স্থির হয়ে যায় এবং মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি যা গ্রহণ করে নেয়, তাই হচ্ছে উরফ।”
৪. অন্তর: হক আর বাতিল চিনার চতুর্থ ও সর্বশেষ মানদণ্ড হচ্ছে আমাদের অন্তর। এখানে অন্তর বলতে আমরা অনুভূতিসম্পন্ন জাগ্রত অন্তরকে বোঝাচ্ছি। সহিহ মুসলিমের হাদিসে এসেছে, রাসূল সা. বলেছেন
الإثمُ ما حاكَ في صدرِكَ، وكرِهتَ أنْ يطَّلعَ عليه النّاسُ.
“যা তোমার অন্তরে অস্বস্তি তৈরি করে এবং তুমি চাও না তা মানুষের সামনে প্রকাশ পাক, তাই হচ্ছে পাপ।” আল আদাবুল মুফরাদ : ২২৬
স্মর্তব্য যে, প্রথম তিন মানদণ্ডের ভিত্তিতে কোনো বিষয়ের সমাধান না পাওয়া গেলেই কেবল অন্তরের ফতোয়া বা মতামতের অনুসরণ করতে হবে। প্রথমবারেই কোনো বিষয় হক নাকি বাতিল জানার জন্য অন্তরের শরণাপন্ন হওয়া যাবে না। বরং শরিয়ত, আকল ও সামাজিক উরফে যদি এর সমাধান না মিলে, তখনই কেবল অন্তরের ফতোয়ার অনুসরণ করতে হবে। (হক আর বাতিল চিনতে অন্তরের ফতোয়ার অনুসরণকে চতুর্থ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে কারণ) একজন মুমিনের অনুভূতি তো তাকে হিদায়াতের পথেই নিয়ে যাবে এবং বাতিল থেকে দূরে রাখবে।
অতএব, আমরা যদি উপর্যুক্ত মানদণ্ডগুলো অনুসরণ করি, তাহলেই আমরা হক আর বাতিল চিনতে পারব।
হদিস: (https://youtu.be/9rIjk4RYApg?si=DKgR44F3TajM0qoI)
তরজমা করেছেন মু. সাজ্জাদ হোসাইন খাঁন ।