
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি নাকি পরগাছা?
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে কি এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা সংবিধান ও ইতিহাস দুইটার আলোকেই আলোচনা করতে পারি। বর্তমান রাজনৈতিক সংকটকালে বাংলাদেশে কিছু নতুন দল তৈরি হয়েছে, যারা ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার কর্তৃক স্বাধীনতার চেতনা হিসেবে “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার”-এর যে তিনটি মৌলিক নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছিল, সেটাকে মেনে নিয়ে রাজনীতি করতে চায় বলে জানিয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো— কোনো নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনার পিছনে যে স্পিরিট বা চেতনা কাজ করে সেটা কি ঐ ঐতিহাসিক ঘটনার আগেই তৈরি হয় নাকি পরে, বা ঐ স্পিরিটটাই সেই ঘটনার জন্ম দেয় নাকি ঘটনা সেই স্পিরিটের জন্ম দেয়? আমাদের বর্তমান শতধাবিভক্ত রাজনৈতিক বাস্তবতার পিছনে এই প্রশ্নের সুরাহা না হওয়ার কোন দায় আছে কিনা সেটাও দেখার বিষয় বটে। একইভাবে এই বিভক্তির পিছনে স্পিরিট দায়ী নাকি সে স্পিরিট কী পন্থায় বাস্তবায়ন করা হবে সেটার দ্বন্দ্বই এই বিভক্তির জন্য দায়ী?
পুরো ৬০ এর দশকে এবং তার আগে ও পরে সারা পৃথিবীব্যাপী কমিউনিজমের একটা ঢেউ ওঠে। ১৯৪৮ সালের ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ১৯৪৯ সালের চায়নায় কমিউনিস্ট বিপ্লব, তারপর কোরিয়া যুদ্ধ, ১৯৫৯ সালের কিউবা বিপ্লব সারা বিশ্বের মুসলিম তরুণদেরও দারুনভাবে নাড়া দেয়, যার ঢেউ বর্তমান বাংলাদেশ অংশেও লাগে। ফলে একটি বামপন্থী সাম্যবাদী রাষ্ট্র গঠন করার স্বপ্নে তরুণরা বিভোর হয়ে উঠে। কিন্তু পাকিস্তান ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র হওয়াতে সেখানে বামপন্থী সাম্যবাদী রাষ্ট্র গঠন অনেকটাই অসম্ভব বলে তারা মনে করতে থাকে। ফলে সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য ১৯৬২ সালের শেষের দিকে সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক ও আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য ‘নিউক্লিয়াস’ নামক গোপন সংগঠন তৈরি করে। এরা ছাত্রলীগের ভিতরে থেকে স্বাধীনতার জন্য গোপনে কাজ করত। এই গোপন সংগঠনের প্রায় সবাই ছিল মূলত বাম রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত। যদিও বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে সে রাষ্ট্রের স্বরূপ কি হবে— এ ব্যাপারে তখনও তাদের কোন পূর্ণাঙ্গ ধারণা ছিল না।
অন্যদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জেনারেল উবানের তত্ত্বাবধানে ছাত্রলীগের মধ্য থেকে একটা গ্রুপ নিয়ে মুজিব বাহিনী গঠন করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই মুজিব বাহিনীতে ডান ও বাম দুই ধারাই বর্তমান ছিল। এখানে সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মনির মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন পুনরায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়, তখন ছাত্রলীগের ডান ও বাম ধারার নেতাদের মধ্যে আবার সেই মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর প্রেক্ষিতে ডান ও বামরা আলাদাভাবে ছাত্রলীগের কার্যক্রম পরিচালনা করতে শুরু করে। বাম ধারার অংশে শেখ মুজিবুর রহমানকে দাওয়াত দিতে গেলে তিনি সিরাজুল আলম খানকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, ওনার পক্ষে বাম ধারার রাজনীতি করা সম্ভব না। তখন থেকে শেখ মুজিবুর রহমান নূরে আলম সিদ্দিকীর গ্রুপকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। এখান থেকেই মূলত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর জন্ম হয়। এখন আমরা যদি ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করা অর্থে সেকুলারিজম নেই, তাহলে সেখানেও আমরা সেকুলারিজমের ফ্রেমওয়ার্কর মধ্যেই অন্তত দুইটা মতাদর্শ পাই। একটা হলো ডান, আরেকটা হলো বাম। তাহলে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের যে স্পিরিটের কথা বলা হয়েছে, সেটা কোনো আদর্শের আলোকে ধারণ করা হয়েছে? ডান নাকি বাম? এখানে তো খোদ শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বাম রাজনীতিকে না করে দিয়েছিলেন। যদি সেকুলারিজমকে এই তিনটি মৌলিক নীতিমালার ভিত্তি হিসেবে দাবি করি আর এর মাধ্যমে বাস্তবে বাম ধারাকে সমর্থন করি, তাহলে সেটা ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কেননা শেখ মুজিবুর রহমান নিজে বামপন্থাকে না করেছিলেন। বামপন্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই শেখ মুজিবুর রহমানকে মহান আকারে হাজির করে এবং সেকুলারিজমের অধীন বামপন্থাকে একাত্তরের স্পিরিট হিসেবে দাবি করে অথচ শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বামপন্থাকে না করে দিয়েছিলেন। আবার যেহেতু সিরাজুল আলম খানসহ অনেক বামপন্থী যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল, তাই সেখানে সেকুলার বাম ঘরানার রাষ্ট্র কায়েমের বাসনাও যে কাজ করেছিল সেটাও অস্বীকার করা যায় না।
এখন প্রশ্ন হলো— ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কোনো নির্দিষ্ট স্পিরিটকে সামনে রেখে হয়েছিল নাকি ৭১ সালের চেতনা হিসেবে আমরা বর্তমানে যে বয়ানগুলো পাই, সেটা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এবং তৎপরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধকে সামনে রেখে তৈরি করা হয়েছিল? বা কোন নির্দিষ্ট চেতনার ভিত্তিতে ১৯৭১ সালের যুদ্ধ হয়েছিল? নাকি ৭১ কে পুঁজি করে চেতনা দাড় করানো হয়েছিল?
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার”-এই তিনটি মৌলিক নীতিমালাকে সামনে রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। তার আগ পর্যন্ত আমরা স্বাধীনতার স্পিরিট সম্পর্কে অন্য কোন লিখিত বা মৌখিক বক্তব্য পাই না। নিউক্লিয়াস ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও তারা গোপনে ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় কাজ করত, তাই ১৯৭১ সালের আগে তাদেরও কোন লিখিত বা মৌখিক বক্তব্য পাই না। তারা আগে থেকে কাজ শুরু করলেও সেটা কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ বা স্পিরিটকে সামনে রেখে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছে সেটাও বলা যায় না।
সাধারণত কোনো দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ শুরু করার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয় এবং সে স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত্তি কী হবে সেটাও স্পষ্ট করে বলা হয়। যেমন আফগানিস্তানে তালেবান, ফিলিস্তিনে হামাস ও ফাতাহ, ভারতের কাশ্মীর নিজেদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে। তারা একটা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের একটা আদর্শিক জায়গা আছে, যা তারা নিজেদের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রকাশ করে। কিন্তু এগুলোর সাথে নিউক্লিয়াসের কার্যক্রমের কোন মিল নেই। তাদের প্রকাশ্য কোন স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল না, কোন লিফলেট বা প্রচারপত্র ছিল না, তাদের আদর্শ বা উদ্দেশ্য কি সেটাও প্রকাশিত ছিল না। ফলে তাদের রাজনৈতিক চিন্তার সাথে জনগণ একমত কিনা সেটা বুঝার উপায় ছিল না। আবার স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ছয় দফা আন্দোলন সহ যত ধরনের আন্দোলন হয়েছে, সেখানে অধিকারের কথা থাকলেও স্পষ্টভাবে কোন স্বাধীনতার কথা ছিল না। তিনটি মৌলিক নীতিমালা ও তার ভিত্তি হিসেবে সেকুলারিজমের কথাও ছিল না। ফলে এটা বলার সুযোগ নেই যে, নির্দিষ্ট কোন চেতনা বা আদর্শকে সামনে রেখে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল। বরং এটা বলা যেতে পারে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা ও সে সংগ্রামকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে অস্থায়ী সরকার গঠন ও তিনটি মৌলিক নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছিল। যদি তাই হয়, তাহলে নির্দিষ্ট চেতনা বিশেষ করে সেকুলারিজমকে ১৯৭১ সালের স্পিরিট হিসেবে ধরে নেওয়া যায় না। বলা যায়, নির্দিষ্ট চেতনার আলোকে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয় নি বরং ১৯৭১ সালকে কেন্দ্র করে সব রাজনৈতিক দল নিজেদের মত করে চেতনা তৈরি করে নিয়েছে।
যেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে করা হয় নি, তার আদর্শিক ভিত্তি কি হবে সেটাও বলা হয় নি, তাই সকল মুক্তিযুদ্ধা সেকুলারিজমের মত কোন স্পিরিটকে মেনে নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল— এমনটা বলা যায় না। তাহলে ১৯৭১ সালে কীসের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল? এক কথায় বললে, কোন নির্দিষ্ট চেতনা নয় বরং অভিন্ন লক্ষ্যই মুক্তিযুদ্ধে সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে যুদ্ধ করতে উৎসাহিত করেছিল; আর সেগুলো হচ্ছে—অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক নিপীড়ন বা অন্যায়ভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া।
এখন কথা হলো— যারা নতুনভাবে রাজনৈতিক দল শুরু করেছে, তারা এই সব বিষয়ে নিজেদের সাথে বোঝাপড়া করে নিয়েছে কিনা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না যে, বিষয়টা নিয়ে তাদের মাঝে গভীর বোঝাপড়া আছে। যদি না থাকে তাহলে বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর মতই এক সময় ১৯৭১ সালের চেতনা আসলে কী এবং কোন পন্থায় তা বাস্তবায়ন করা হবে, সে ব্যাপারে তারাও সন্দিহান হয়ে পড়বে এবং মতপার্থক্য তৈরি হবে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ বললেও পাকিস্তান আসলে ইসলামী রাষ্ট্র ছিল না। বরং এটা ছিল সেকুলার রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে ইসলামি রাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা মাত্র। কিন্তু সেকুলার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইসলামী রাষ্ট্র চলায় এর দায়ভার সহজেই ইসলামের উপর এসে পড়েছে।