মেন্যু
Menu

বাংলাদেশের পাকিস্তান অভিজ্ঞতা : রাজনীতি ও বাস্তবতা (১৯৪৭-৭১)

১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

পূর্বকথা

বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেষা পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র বিধৌত; ঐতিহাসিক বঙ্গ, পুণ্ড্র, রাঢ়, গৌড় ও সমতটের একত্রিত রূপ এই ভূমির ইতিহাস, ঐতিহ্য, তাহযীব- তমুদ্দুন বদলেছে শত-সহস্রবার। মৌর্য থেকে গুপ্ত – পাল হয়ে সেন বংশ, কখনো স্বাধীন কিংবা উত্তর ভারতের অধীন থেকে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবিবরণী লিখিত হয়েছে। সনাতন কিংবা বৌদ্ধ – প্রাকৃত যে ধর্মেরই হোক, বাংলা ছিল সম্প্রীতির উদাহরণে ভরপুর। সেন বংশে বর্ণ হিন্দুদের শাসন এই সম্প্রীতির ইতিহাসে কালিমা লেপন করে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে হিন্দু সেনবংশীয় রাজাদের তাড়িয়ে ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী এই এলাকাকে মুসলমান শাসনাধীন অঞ্চলে রুপান্তরিত করেন এবং তার মধ্যমে অঞ্চলে বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের প্রতি সেনদের চালানো জুলুম-বৈষম্যের অবসান হয়। সুলতানী এবং মোঘল আমল – উত্তর ভারত কেন্দ্রীক মুসলিম শাসনের ইতিহাসে বাঙলা কখনো স্বাধীন সালতানাতে বাঙ্গালা কিংবা সুবে বাঙলা ও জান্নাতুল বিলাদ বা বেহেশতের বাগান হিসেবে শাসিত হয়েছে। পরবর্তিতে পলাশির প্রান্তরে সুবে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলে ভারতবর্ষে বৃটিশ ঔপনিবেশিক গোলামীর শাসন শুরু হয়। জিঞ্জির ভেঙে আজাদীর লক্ষ্যে লাখো শহিদের কুরবানি ও দীর্ঘ সংগ্রামে অবশেষে বাংলা ও ভারতবর্ষের মুস্লমানরা লাভ করে নতুন স্বাধীন দেশ – পাকিস্তান। ৪৭ এ অর্জিত পাকিস্তান তেইশ বছরের মাথায় ভেঙে মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে নাম লেখায় বাংলাদেশ।

ইতিহাসের পরতে পরতে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি ঘটনা লিপিবদ্ধ রয়েছে বিভিন্নভাব ও ভঙ্গিতে। বিজয়ী ও বিজিতদের বয়ান, প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান কিংবা আদর্শিক বয়ান – আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, ভৌগোলিক সীমানা, রাজনৈতিক আদর্শ, শাসনতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং ইতিহাস – সবগুলোই সেই বিভিন্ন বয়ানের একটি ধারাবাহিকতা। মুসলমানদের শাসনাধীন পৃথিবীর অন্যতম ধনী এলাকা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, ইনসাফ ভিত্তিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সহাবস্থানের বিপরীতে ব্রিটিশ শাসন আমাদের ইতিহাসে একটি গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। যার ফল স্বরূপ অর্থনৈতিক দুর্দশা, সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও রাজনৈতিক বিভেদ-বিভাজন আমাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পলাশীর পরাজয়ের পর এই অঞ্চলের শাসন কর্তৃত্ব যখন ইংরেজদের হাতে যায়, তখন আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাদীক্ষা সহ সর্বত্র মুসলমানরা ছিল তাদের চে’ উচ্চতর অবস্থানে আসীন। ক্ষমতা হারানোর পর আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন ভাবে নিপীড়িত ও দুর্বল অবস্থা সত্ত্বেও এদেশের আজাদী পাগল মানুষেরা মজনু শাহ – ভবানী পাঠকের নেতৃত্বে ফকির-সন্যাসী বিদ্রোহ, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর সাথে বালাকোট, বাঁশের কেল্লায় তিতুমীর, ফরিদপুরে হাজী শরীয়ত উল্লাহ-দুদু মিয়ার নেতৃত্বে এক দীর্ঘ লড়াইয়ে নেমে পড়েছিল। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ পর্যন্ত ইংরেজ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সকল লড়াইয়ের নেতৃত্বে ছিল মুসলিমরা। তাদের সাথে হিন্দু, নেটিভ খৃষ্টান ইত্যাদি ধর্মের মানুষেরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ে শামিল হয়েছিল। এই লড়াইগুলোকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন ও প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যে ইংরেজরা এগুলোকে ওহাবি ও ধর্মান্ধদের আন্দোলন বলে বর্গায়ন করার প্রয়াস চালিয়েছিল।

রাষ্ট্রীয় সকল অঙ্গসংগঠন – হোক সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র, শিক্ষা, কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, সব জায়গাতেই হিন্দুরা ইংরেজদের সহযোগী হওয়ায় জাতিগত ভাবে তারা লাভবান হয়। দীর্ঘদিনের সংগ্রাম ও ত্যাগের প্রেক্ষিতে বঙ্গের ভাগ-বাঁটোয়ারার মাধ্যমে মুসলমানরা কিছুটা রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতির চর্চার সুযোগ পায়। কিন্তু উগ্র হিন্দু ভদ্রলোকদের সমর্থনে সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতাদের ব্রিটিশ বিরোধী সন্ত্রাসী আন্দোলন এবং বৃটিশ সমর্থিত কংগ্রেসের উগ্রহিন্দু নেতাদের স্বদেশী ও তেভাগা আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও তুমুল বিরোধিতায় বঙ্গভঙ্গ রদের মাধ্যমে মুসলমানরা তাদের সর্বশেষ আশার প্রদীপ হারিয়ে ফেলে। এর মাধ্যমে ভারতে হিন্দু-মুসলিম পৃথক রাজনীতির সুত্রপাত ঘটে। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে মুসলমানরা কংগ্রেসের ভারত নামক হিন্দুরাষ্ট্র প্রকল্প থেকে বেরিয়ে মুসলিম পরিচয়ের ভিত্তিতে শতসহস্র আলেম-ওলামা, রাজনৈতিক নেতা, সাধারণ জনতার খুন ও ঘামের কুরবানীর মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র লাভ করে। পাকিস্তান ছিল এমন একটি দেশ – যার ভৌগলিক অবস্থান উপমহাদেশের দুই প্রান্তে দুটি অংশে বিভক্ত।

উপমহাদেশে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু ১৯৪৭ এর ১৪ই আগষ্ট। ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব বাংলা হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান; একাত্তরের পর বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই পাকিস্তান যাত্রার ইতিহাস নানা রাজনীতি ও আদর্শিক অবস্থানের কারণে যেমন গুরুত্বপুর্ণ, তেমনি এই অংশটা সবচেয়ে অন্ধকারে আচ্ছন্ন। ইতিহাসকে রাজনীতির বেড়াজালে আটকে সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দীর্ঘ যাত্রার ধোঁয়াশা পূর্ণ ইতিহাস থেকে ভ্রান্তির জাল সরিয়ে সত্যকে সামনে আনাই বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের একমাত্র উদ্দেশ্য। যাতে ভাবুক ও চিন্তাশীল মনে কিছু যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৪৭ এ মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সক্ষমতা ছিল খুবই সীমিত। উপমহাদেশে শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য বুদ্ধিবৃত্তি সর্বক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল বাংলাভাষী মুসলমানেরা। ৪৭ সালে পুর্ব বাংলায় শিক্ষার হার ছিল ৬ শতাংশের মতো। এর মধ্যে আবার হিন্দুদের সংখ্যাধিক্য ছিল চোখে পড়ার মতো। বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ এসব প্রদেশে মুসলমানদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগের বেশী ছিল না ।

পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম গোলযোগ সৃষ্টি হয় ভাষা সমস্যাকে কেন্দ্র করে। যদিও সদ্য স্বাধীন একটি দেশ, যা জিন্নাহর ভাষায় ‘পোকায় খাওয়া পাকিস্তান’ – তার আরো বহু গুরুতর সমস্যা ছিল, যেগুলোর আশু সমাধান জরুরী হয়ে পড়েছিল। পাঞ্জাবি, পশতুন, উর্দুভাষী মুহাজির, সিন্ধি, বেলুচ, কাস্মীরী ও বাঙালী – বহু ভাষা ও জাতিস্বত্বার পাকিস্তানের ঐক্যের জন্যে জরুরী ছিল একটি কমন লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা – যার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য-সংহতি ও ভাবের আদান-প্রদান সহজ হবে। এই উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা করা হয় উর্দুকে। এখানে বলে রাখা দরকার যে, উর্দূ পূর্ব বাঙলা এবং পশ্চিম পাকিস্তান কোনো অংশের লোকেরই মাতৃভাষা ছিল না। কিন্তু বিগত শতকের রাজনৈতিক ঢামাঢোলে এই নতুন ভাষাটার একটা রাজনৈতিক পরিচয়ের উম্মেষ ঘটেছিল। ফলে উর্দূ-হিন্দি বিরোধের সোময় মুসলমানরা উর্দুকে নিজেদের ভাষার মর্যাদা দিয়েছিল।

ভাষা প্রশ্নে কায়েদে আজমের অবস্থান ছিল স্পষ্ট। তার বক্তব্যটুকু পড়লেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে উঠে - ‘‘There can, however, be only one lingua franca, that is the language for inter-communication between the various provinces of the state, and that language should be Urdu and cannot be any other. The state language, therefore, must obviously be Urdu, a language that has been nurtured by a hundred million Muslims of this subcontinent, … embodies the best that is in Islamic culture and Muslim tradition and is nearest to the language used in other Islamic countries.”1

প্রাদেশিক ভাষা কী হবে সেটা ছেড়ে দেয়া হয় প্রাদেশিক সরকারের হাতে। কায়েদে আজম তার রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে পূর্ব বাঙলার প্রাদেশিক ভাষা বিষয়ে বলেন - “Whether Bengali shall be official language of this province is a matter of elected representatives of the people of this province to decide.”2

ভাষা আন্দোলনের নামে তমুদ্দন মজলিশ ও তার সেকুলার মিত্ররা রাজপথে গোলযোগ সৃষ্টি করে তৎকালীন সরকারের ভূল পলিসির কারণে সময়ও তাদের পক্ষে ছিল। ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য যে নিছক বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেওয়া ছিল না বরং তা ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এ আন্দোলনের সাথে অতি সক্রিয় হয়ে পড়ে সেসব বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতা, যারা ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রচন্ড বিরোধীতা করেছিলেন, একেবারে শুরুতেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জাতীয় ঐক্যের সূচনাকে নষ্ট একটি করে দেয়ার লুকায়িত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ফাঁস করেন ফাহমিদ-উর-রহমান –

‘‘একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, তা নির্ভর করে অনেক ঐতিহাসিক বাস্তবতার ওপর, শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর নয়। আবার পাকিস্তান হয়েছিল ভারতীয় মুসলিমদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য, শুধু বাংলাভাষীদের নৃতাত্ত্বিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য নয়।...তমুদ্দুন মজলিসের উদ্যোগেই প্রথমে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং এই পরিষদের নেতৃত্বে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও মানবিক সংকটের মতো বড় বড় সমস্যাকে বাদ দিয়ে ভাষার মতো অপ্রধান সমস্যাকে রীতিমতো রাজনীতিকরণ করে প্রধান করে তোলা হয়। তমুদ্দুনের একার পক্ষে এটা করা সম্ভব ছিল না। নেপথ্যে থেকে কমিউনিস্টদের বুদ্ধি, পরামর্শ ও সাংগঠনিক সহায়তা, কংগ্রেসের রাজনৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্বহারা গ্রুপের উস্কানি মিলিত হয়ে তখনকার মুসলিম লীগ সরকারকে রীতিমতো টালমাটাল করে দেয়। এদের সবার উদ্দেশ্য একরকম ছিল না। কমিউনিস্ট পার্টি ও কংগ্রেস চেয়েছিল এই আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানকে খতম করে দেওয়া। অন্যদিকে মুসলিম লীগের বিদ্রোহী অংশের প্ররোচণা ক্ষমতা-কেন্দ্রিক হলেও এদের ভূমিকা পাকিস্তানকে যারা চায়নি, তাদের হাতকে শক্তিশালী করেছিল। বিশেষ করে যারা পাকিস্তান এনেছিল, তাদের একাংশ যখন এমন এক আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়লো, যা মুসলিম ভাবাদর্শকে আঘাত করতে উদ্যত হলো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একেবারে শুরুতেই মুসলিম জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ মাথা তুলে দাঁড়াবার আগেকে বাভোবে বড় একটা ঝাকি খায়। ফলে এ-দেশে এটি আর শক্তভাবে জায়গা করতে পারেনি।’’3

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরের পর ভাষা আন্দোলন রীতিমতো স্থিমিত হয়ে পড়ে। খাজা নাজিমুদ্দীন জিন্নাহর নির্দেশে আন্দোলনকারীদের দাবী মেনে নিলে ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। ১৯৪৮ এ কায়েদে আজমের ইন্তেকালের পর পাকিস্তান তার রাজনৈতিক অস্থিরতায় আটকে পড়ে। তার মৃত্যুর তিন বছরের মাথায় ভাষা আন্দোলন আবার নবজীবন লাভ করে। ফলে কতিপয় প্রাণের বিয়োগে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীর মতো ঘটনা সংঘটিত হয়। এই সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং পুর্ব বাঙলার প্রাদেশিক গভর্নর দু’জনই ছিলেন পূর্ব বাঙলার মানুষ।

ভাষা আন্দোলনের অনাকাঙ্ক্ষিত রক্তপাত এবং ১৯৫৪ এর প্রাদেশিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় যুক্তফ্রন্টকে সরকার গঠনের সুযোগ দেয়। আওয়ামী লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলামী, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দলসমূহকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর বিরোধ এবং একপর্যায়ে ভাসানীর আওয়ামী লীগ হতে বেরিয়ে ন্যাপ গঠন করা এবং সোহরাওয়ার্দীর সাথে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণেই যুক্তফ্রন্টের পতন ঘটেছিল। এর ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে শাহাবুদ্দিন আহমদের লেখায় “হোসেন সোহরাওয়ার্দী শেরে বাংলাকে শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রিসভায় নেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু বদমেজাজী ও অপরিণত বুদ্ধি বলে শেরো বাংলা শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রিসভায় নিতে অস্বীকৃতি জানালেন।’’4

আওয়ামী লীগের কোন সদস্য ছাড়াই শেরে বাংলা যুক্তফন্টের মন্ত্রিসভা গঠন করেন এতে আওয়ামী লীগ ক্ষীপ্ত হয়ে শেরে বাংলার সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য বিভিন্ন ধরনের চেষ্টা করতে থাকে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকার জেল গেটে পরিকল্পিত আক্রমণ হয়। এতে এক কিশোরের মৃত্যু হয় পুলিশের গুলিতে। এর ফায়দা নেয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের লাশের রাজনীতির ব্যাখ্যায় শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন- “আন্দোলনের মাধ্যমে যদি কোন লাশ পাওয়া যায়, তা হল নেতাদের কাংক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছার মাধ্যম ৫২ সালে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ সরকারের গুলিতে মারা গিয়েছিল নিরীহ জনগণ। এতে লাভবান হয়েছিল মুসলিম লীগ বিরোধী দলগুলো, যারা পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছিল। আবার ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের শেরে বাংলা সরকারের গুলীতে মারা গিয়েছিল এক কিশোর এবং লাভবান হয়েছিল যুক্তফ্রন্টের অপর শরীকদল আওয়ামী লীগ। তাই ঘটনার ১৩ দিন পর ১৫ই মে আওয়ামী লীগ হতে আতাউর রহমান, আবুল মনসুর আহমদ, আব্দুস সালাম খান, হাশিমুদ্দিন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন এবং পিছনে পড়ে থাকল এক কিশোরের লাশ।”5

এরপর অতি অল্প সময়ে ঘটে যায় অনেক কিছু। যা উঠে আসে আবুল মনসুরের লেখায় - “পূর্ব বাংলায় শিল্পসমূহে বাঙ্গালী অবাঙ্গালী দাঙ্গা এবং কলকাতায় শেরেবাংলার আবেগময়ী বক্তব্যের কারণে কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী পূর্ব বাংলায় ৯২-ক ধারা প্রয়োগ করে ১৯৫৪ সালের ৩০শে মে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বহিস্কৃত করে এবং গভর্ণরের শাসন প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৫৫ সালের ৩ জুন পূর্ব বাংলা হতে গভর্ণরের শাসন উঠে গেল এবং আওয়ামী লীগ হতে দলছুট কিছু অংশের সমর্থন এবং নেজামে ইসলামীকে নিয়ে শেরে বাংলা ৬ জুন পূর্ব বাংলায় নতুন সরকার গঠন করলেন। এক্ষেত্রে শেরে বাংলা নতুন সরকারের মূখ্যমন্ত্রী না হয়ে তার দলের আবু হোসেন সরকারকে মূখ্যমন্ত্রী করেন এবং নিজে পরে পূর্ব বাংলার গভর্ণর হন।’’6

আওয়ামী লীগ ক্ষমতা আসতে না পারায় তারা অন্ধভাবে শেরেবাংলার বিরোধীতা করা শুরু করল এবং প্রয়োজন দেখা দিল নিরীহ এবং বোকা জনগণের লাশের। এ ব্যবস্থাটি খুবই সুন্দরভাবে সমাধান করলেন আওয়ামী লীগের জনাব শেখ মুজিবুর রহমান। মেজর রফিকুল ইসলাম লিখছেন – “এ সময় কিছু তরুণকে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান আপোসহীনভাবে শেরেবাংলার বিরোধীতা করে যাচ্ছিলেন। ১৯৫৬ সালের ৪ অগাস্ট তারিখে খ্যাদ্যের দাবীতে ঢাকাতে নিরন্ন মানুষ মিছিল করে। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। এতদসত্ত্বেও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে জনগণ ৩ জন বুভুক্ষু গ্রামবাসী নিহত হয়। শেখ মুজিব ১ জনের মৃতদেহ তুলে নিয়ে মিছিল সহকারে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করেন। আবার ৪ সেপ্টেম্বর খাদ্যের দাবীতে বিক্ষোভ মিছিল চলছিল। ঢাকার জেলা প্রশাসক ১৪৪ ধারা জারি করলে বিক্ষোভকারীরা তা মানলো না। ৪ নিহত ও শত শত লোক আহত হয়।”7

১ মাসের ভিতরে ৭ জনের লাশের ফলে পূর্ব বাংলার গভর্ণর শেরেবাংলা বাধ্য হয়ে নিজ দলের মন্ত্রিসভা বাতিল করেন তাই ১৯৫৬ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানকে মূখ্যমন্ত্রী করে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। ৬ দিন পর ১২ই সেপ্টেম্বর কেন্দ্রে সোহরাওয়ার্দি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। ফলে কেন্দ্রে ও প্রদেশে আওয়ামলীগ এর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রে আওয়ামীলীগের শরীক দল রিপাবলিকান পার্টি পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিরোধে আওয়ামীলীগের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করায় ১৯৫৭ সালের ১১ই অক্টোবর সোহরাওয়ার্দি প্রধানমন্ত্রীর পদ হতে পদত্যাগ করেন। আওয়ামীলীগের হাত হতে কেন্দ্রের ক্ষমতা চলে যাওয়ার সুযোগে ১৯৫৮ সালের ৩১শে মার্চ শেরেবাংলা আওয়ামী লীগ সরকারকে বরখাস্ত করে তার দলকেই আবার পূর্ব বাংলার ক্ষমতায় বসান।

কেন্দ্রে সোহরাওয়ার্দী হুমকি দেন শেরেবাংলাকে গভর্ণর পদ হতে বরখাস্ত না করলে পাকিস্তানের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খানের প্রতি তার সমর্থন প্রত্যাহার করবেন। তিনি ৪ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ব বাংলার গভর্ণর শেরে বাংলাকে বরখাস্ত করেন এবং আতাউর রহমানের নের্তৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে আবার ১৯৫৮ সালের ১৮ই জুন আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে পুনরায় শেরে বাংলার দল আবু হোসেনের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। কিন্তু এ সরকার মাত্র তিন দিন টিকে ছিল। এভাবে পূর্ব বাংলা প্রদেশে বারবার সরকার পরিবর্তন হওয়ায় প্রেসিডেন্ট ইসকান্দর মীর্জা পূর্ব বাংলায় প্রেসিডেন্টের শাসন চালু করেন। কিন্তু দু’মাস পর ইসকান্দর মীর্জা বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট শাসন তুলে নিতে এবং পুনরায় ১৯৫৮ সালের ২৫শে অগাস্ট আতাউর রহমানের নের্তৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ১৯৫৮ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর পূর্ব বাংলার সংসদ অধিবেশনে সরকার দল এবং বিরোধী দলের প্রচন্ড হট্টগোলের মধ্যে স্পিকার জনাব শাহেদ আলী আহত এবং ২৬শে সেপ্টেম্বর মৃত্যু বরণ করেন।”8

স্পীকার শাহেদ আলীর মৃত্যুর কিছুদিন পরই ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসেন। যুক্তফ্রন্টের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও কৃষক-শ্রমিক পার্টির বারবার ক্ষমতার পালাবদল এবং দুর্নীতির কারণে পূর্ব বাংলার মানুষ জেনারেল আইয়ুব খানকে অকুন্ঠ চিত্তে সমর্থন জানায়। এ ব্যাপারে জনাব অলি আহাদ উল্লেখ করেছেন, ‘‘শেখ মুজিবুর রহমান ১২ই অক্টোবর দুর্নীতির কারণে গ্রেফতার হন এবং পরবর্তীতে আদালতে একটি মামলায় তাঁর দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ড ও ৫০০০ টাকা জরিমানা হয়। মুসলিম লীগ, যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামীলীগের মন্ত্রি মেম্বার, নেতা-উপনেতা দেশ সেবার বদৌলতে ঢাকায় স্ব-স্ব বাড়ী-ঘর নির্মাণে অপূর্ব দক্ষতার পরিচয় দেন। ধানমন্ডি এলাকায় আওয়ামী লীগ সদস্যদের নির্মিত ঘর-বাড়ীসমূহ আওয়ামী লীগ কলোনী আখ্যা পায়। দুর্নীতির দরুন লোকচোখে হেয় রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক অঙ্গন হইতে বিদায় দেওয়ার কারণে সামরিক অভ্যুত্থানে সেই সময় জনগণ আনন্দিত হইয়াছিল এবং জেনারেল আইউব খান সাধারণ লোকের প্রাণঢালা সমর্থনও লাভ করিয়াছিলেন।”9

একটি রাষ্ট্রের বুনিয়াদি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শিক্ষা, অবকাঠামোগত খাত, অর্থনৈতিক ও শিল্পক্ষেত্র, প্রতিরক্ষার জন্য সামরিক ক্ষেত্র, সর্বোপরি রাষ্ট্র পরিচালনায় সহায়তার জন্য বেসামরিক আমলাতন্ত্র অন্যতম। আইয়ুব খান সেনশাসক হলেও তার আমলেই পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রিয় বুনিয়াদের গঠন পক্রিয়া দৃশ্যমান হয়। আবুল মনসুর আহমদের জবানীতে এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের ২৩ বছরের পাকিস্তান অভিজ্ঞতার ইতিহাস আলোচনায় বিভিন্ন ধরণের পুর্বানুমান কাজ করে। ঐতিহাসিকদের একটি বড় অংশ এই যাত্রায় পক্ষপাতের আশ্রয় নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার খাহেশে এমন ভাবে ইতিহাস উপস্থাপন করেন, যাতে মনে হয়, পাকিস্তান মানেই পুর্ব পাকিস্তানের প্রতি বঞ্ছনার ইতিহাস। অভাব এবং অভিযোগের বিরাট ফিরিস্তি। কিন্তু ২৩ বছরের পাকিস্তান আমলের সব কিছুই কী পুর্ব বাংলা তথা পুর্ব পাকিস্তান বিরোধী ছিল? এই আমলে কী পুর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক কাঠামর উন্নয়ন কিছুই হয়নি? বক্ষ্যমান আলোচনায় সে বিষয়গুলো অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা দৃশ্যমান থাকবে।

পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা (১৯৪৭-৭১)

উপনিবেশ আমলে ব্রিটিশদের সহযোগী ছিল বাংলাভাষী হিন্দুরা। ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ আমলে বাংলা ভাষাভাষীদের শিক্ষার সিংভাগ উন্নয়ন হয়েছে হিন্দু অধ্যুসিত বর্তমান পশ্চিম বাংলায়, যা ৪৭ এ ভারতের অংশ হয়েছে। তাই পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী মুসলমান শিক্ষা ক্ষেত্রে একেবারেই পিছিয়ে ছিলো। সহজ ভাষায় পূর্ব বাংলা ছিল অশিক্ষিত পশ্চাৎপদ, প্রশাসনিক ও টেকনিকালী অদক্ষ মানুষে পূর্ণ। যে স্বল্প কিছু স্কুল, কলেজ ছিল; বেশিরভাগই ছিল হিন্দু জমিদারদের অর্থে ও জমিতে প্রতিষ্ঠিত - যেখানে মুসলমানরা ছিল অচ্ছ্যুত, অস্পৃশ্য। হিন্দু ছাত্রদের সাথে এক বেঞ্চিতে বসা ও কুরবানির ঈদের পর স্কুলে ঢুকতে নিষেধাজ্ঞা, স্বরস্বতী পূজার চাঁদা ও অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল সাধারণ ঘটনা। ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার সাক্ষরতার হার ছিল ১২ শতাংশ। তবে এই ১২ ভাগের ৯৫ ভাগের বেশি ছিল বাঙালি হিন্দু অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানের সাক্ষরতার হার ছিল ৫ ভাগেরও নিচে।10

৪৭ এ স্বাধীনতার পর দেখা গেল পূর্ব বাংলায় মুসলমানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আছে মাত্র ১ টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যা বঙ্গভঙ্গ রদের প্রেক্ষিতে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৩৮ সাল পর্যন্ত আরবি, উর্দু, ফারসি, ইসলাম শিক্ষা এই বিভাগগুলো বাদ দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমান শিক্ষকদের মধ্যে ইংরেজি বিভাগে ড. মাহমুদ হাসান, বাংলার ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ইতিহাসের ড. মাহমুদ হোসেন নাম খুঁজে পাওয়া যায়। ৪৭ এর দেশভাগের পরে শিক্ষিত হিন্দু যারা ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে এখানে ছিলেন তারা অধিকাংশই পূর্ব বাংলা ছেড়ে ভারতে চলে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং ছাত্র শূন্যতার পরিপ্রেক্ষিতে জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন কলেজ থেকে শিক্ষক, ছাত্র এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। পাকিস্তান হওয়ার আগে, পুর্ব বাংলায় ১টি মাত্র মেডিকেল কলেজ - ঢাকা মেডিকেল কলেজ, একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ - আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, এবং কারমাইকেল কলেজ, সিলেট এমসি কলেজের মতো অর্ধডজন ডিগ্রি কলেজ ছিল। আর ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, ইডেন কলেজ ইত্যাদির মতো ৮ টি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। কোন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছিল না।

৪৭ এ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার শিক্ষার উন্নয়নের স্বার্থে অধিক পরিমাণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মানের উদ্যোগ গ্রহন করে। যদি তালিকা করা হয়, তাহলে-

৩ টি বিশ্ববিদ্যালয়;

  • রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৩)

  • চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৬)

  • জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭০)

৪ টি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়;

  • পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ( পরে বাংলাদেশের বুয়েট) ১৯৬২ (আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের রুপান্তরিত রুপ)

  • রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) ১৯৬৪

  • চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) ১৯৬৮

  • খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ১৯৬৯

৮ টা সরকারি মেডিকেল কলেজ;

  • চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (১৯৫৭)

  • রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (১৯৫৮)

  • ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (১৯৬২)

  • সিলেট মেডিকেল কলেজ (১৯৬২)

  • স্যার সলিমুলস্নাহ মেডিকেল কলেজ (১৯৬৩)

  • Institute of Postgraduate Medicine and Research পিজি ( পোস্ট গ্রাজুয়েট ) হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৫ ) বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ।

  • শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (১৯৬৮)

  • রংপুর মেডিকেল কলেজ (১৯৭০)

১টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়;

  • পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬১) পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

৮৭ টি কলেজ;

৪টি ক্যাডেট কলেজ;

  • ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ (১৯৫৮)

  • মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ (১৯৬৩)

  • ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ ( ১৯৬৩)

  • রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ (১৯৬৫)

এছাড়াও কিছু প্রতিষ্ঠান-

  • The Mercantile Marine Academy পরিবর্তীত নাম Bangladesh Marine Academy (১৯৬২)

  • ইস্ট পাকিস্তান টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট’ ১৯৫০ বর্তমান নাম বুটেক্স ।

  • চট্টগ্রাম কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ১৯৬২

এছাড়াও ১৭ টি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট, কিছু বিশেষায়িত কলেজ, ইনস্টিটিউট, নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাকিস্তান আমলে। এছাড়া দেশ ব্যাপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কয়েক হাজার প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাই স্কুল।

১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমানদের স্বাক্ষরতার হার ছিল ৫ ভাগেরও কম। ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে স্বাক্ষরতার হার দাড়ায় ২১.৫%। অর্থাৎ মাত্র ১৩ বছরে এই অঞ্চলের স্বাক্ষরতার হার ৪/৫ গুন বাড়ে।11

পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের আদমশুমারী না হওয়ায় পাকিস্তান আমলের প্রকৃত স্বাক্ষরতার হার জানা যায়নি।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫ টা, যার মধ্যে ৪ টাই পাকিস্তান আমলের। অর্থাৎ ২৩ বছরের পাক আমলে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে ৪ টা, আর পরবর্তী ৫০ বছরে হয়েছে ১ টা। “পাকিস্তান আমলের মাত্র ২০ বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৭টি বিশাল আকারের বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ একাত্তরের পর, বাংলাদেশের বিগত ৩৭ বছরের ইতিহাসে সে মাপের বিশ্বাবিদ্যালয় একটিও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যা হয়েছে অতি ছোট মাপের - খুলনা, কুষ্টিয়া ও সিলেটে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি তার উদাহরণ। পাকিস্তান আমলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক মানের বিশাল আকারের ৭টি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠিত হয় বড় বড় ক্যাডেট কলেজ ও রেসিডেনশিয়াল মডেল স্কুল ।”12

পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের অবকাঠামোগত অবস্থা (১৯৪৭-৭১)

ব্রিটিশ শাসনের ১৯০ বছরে পূর্ব বাংলায় আন্তর্জাতিক মানের কোন বড় শহরই ছিল না এটা দিয়েই সহজে বোঝা যায় অবকাঠামোগত অবস্থা কত ভয়াবহ ছিল, রাজধানীর উপযোগী একটি শহরও ছিল না, ছিল কিছু মফস্বলের জেলা শহর। ৪৭ এর পর প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা ছিল অনুন্নত একটি মফস্বল শহর।

অভিজ্ঞ সাংবাদিক লেখক এইচ. এম আব্বাসী লিখেন: ‘ঢাকা যখন রাজধানীতে পরিণত হয় তখন সেখানে মুসলমান কিংবা হিন্দু মালিকানায় একটি সংবাদপত্রও প্রকাশিত হতো না। মাত্র ৫ ওয়াটের একটি রেডিও ষ্টেশন ছিল এবং বেশ কয়েক বছর সময় লাগে সেখান থেকে বাংলা দৈনিক আজাদ ও ইংরেজী দৈনিক মনিং নিউজ প্রকাশনা শুরু হতে। আমার একটা বড় দায়িত্ব ছিল পত্রিকার ছবি ব্লক করে করাচী থেকে বিমান যোগে তা ঢাকায় প্রেরণ করা যা নতুন ইংরেজী দৈনিক অবজারভার-এ প্রকাশিত হতো অর্থাৎ ঢাকায় ব্লক বানানোর কোন মেশিনও ছিল না ।”13

ঢাকা শহরে কোন বড় আকারের বিল্ডিং ছিল না। ছিল না কোন আন্তর্জাতিক মানের হোটেল ও বড় আকারের কোন মসজিদ। রাষ্ট্রপরিচালনার স্বার্থে যে প্রাতিষ্ঠানিক স্থায়িত্ব দরকার ছিল তা মূলতো হয় আইয়ুব খানের আমলে। আইয়ুব খান সামরিক শাসক ছিলেন সত্য, কিন্তু তার সময় পূর্ব বাংলার অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছিল। ঢাকাকে রাজধানী হিশেবে প্রতিষ্ঠার পর সত্যিকারে ফাংশনাল করা হয়েছিল সেই সময়েই আর সাধারনত উন্নয়ন হয় রাজধানীকে কেন্দ্র করে তাই উন্নয়ন শুরু হয়েছিল ঢাকায় পরে তা সারা দেশে ছড়ায় যায়। পূর্ব বাংলায় অবস্থিত উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো উন্নয়নের তালিকা করলে দেখা যাবে বর্তমান বাংলাদেশের অধিকাংশ জাতীয় স্থাপনা পাকিস্তান আমলে তৈরি করা। যেমন:

  • বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন পাকিস্তানের গণপরিষদের জন্য তৈরি।

  • বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মসজিদ, পাকিস্তানের সেই সময়ের সবচেয়ে বড় মসজিদ।

  • বাংলাদেশের জাতীয় রেল স্টেশন কমলাপুর রেল ষ্টেশন।

  • বাংলাদেশের জাতীয় যাদুঘর আগের যাদুঘরটি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

  • বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানা মিরপুর চিড়িয়াখানা।

  • বাংলাদেশের জাতীয় বিমানবন্দর কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এখন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।

  • বাংলাদেশের জাতীয় টেলিভিশন ভবন রামপুরা পাকিস্তানের টেলিভিশন সেন্টার লাহোরে ও ঢাকায় একসাথে স্থাপন করা হয়। লাহোরে সম্প্রচার শুরু হওয়ার একমাস পরে ঢাকায় সম্প্রচার শুরু হয়।

  • এই প্রদেশে মাত্র ৫ কিলোমিটার শক্তি সম্পন্ন বেতার কেন্দ্র ছিল পরে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর, সিলেট উচ্চ শক্তির বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়।

  • বাংলাদেশের জাতীয় স্টেডিয়াম পূর্বের ঢাকা স্টেডিয়াম বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম।

এগুলো ছাড়াও,

  • আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ সচিবালয় যা ১৯৭১ এর পর সচিবালয়ের পুরাতন ভবনটি ভেঙে ২০ তলা ভবন তৈরী করা হয় ।

  • বাংলা ভাষা সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য বাংলা একাডেমি ।

  • ইসলামিক একাডেমি বর্তমানে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ।

  • দেশের একমাত্র সমরাস্ত্র কারখানা (Ordinance Factory) এবং গাজীপুর মেশিন টুলস ফেক্টরি ।

ঢাকাকে আধুনিক ও পরিকল্পিত নগর করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল -

শাহবাগ হোটেল বর্তমান নাম হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল । শেরাটন হোটেল বর্তমান নাম হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাও । ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের ছাত্রদের দুটি আবাসিক হল কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ হল (সূর্য সেন হল), আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল হল ( সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) হাইকোর্ট বিল্ডিংসহ শহরের বড় বড় এমারতগুলো গড়ে উঠেছিল পাকিস্তান আমলেই।

শেরে বাংলা নগর পাকিস্তানের Second capital হিসাবে শেরেবাংলা নগরকে পরিকল্পিতভাবে তৈরী করা হয় । এছাড়াও ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গুলশান, বনানী প্রভৃতি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গঠন ও নগরায়ন করা হয় ।

রাজউক, ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট যার বর্তমান নাম রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ঢাকার নিউ মার্কেটসহ বিভাগীয় শহরে এক একটি নিউ মার্কেট তৈরী করা হয়।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকরা চলে যাবার সময় ঢাকায় কোনো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিল না। অথচ ভারতের প্রায় সব শহরেই তখন কেন্দ্রীয়ভাবে বিদ্যুৎ সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা ছিল। ঢাকার নবাব পরিবারের জন্য তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দুটি জেনারেটরের ব্যবস্থা ছিল। ১৯৪৮ সালে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিস্থিতির পরিকল্পনা ও উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ অধিদপ্তর তৈরি করা হয়। ১৯৫৯ সালে পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ওয়াপদা) তৈরি করা হয়। WAPDA এর অধীনে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও শতশত বাধ ও সেচ প্রকল্প গ্রহন করা হয় । ঢাকা রক্ষা বাঁধ সহ বহু উন্নয়ন পরিকল্পনা নেয়া ও বাস্তবায়ন করা হয়। শাহজীবাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এমনকি এখন পর্যন্ত দেশের একমাত্র জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্ণফুলী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হয় পাকিস্থান আমলে। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা গিয়ে দাঁড়ায় ০ মেগাওয়াট থেকে ৪৭৫ মেগাওয়াট। যার অধিকাংশই উৎপাদিত হত প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল চালিত জেনারেটর দ্বারা, স্টিম টারবাইন জেনারেটর দ্বারা এবং জল বিদ্যুৎ থেকে।

আণবিক শক্তি কেন্দ্র, যা এখন পরমাণু শক্তি কেন্দ্র নামে পরিচিত। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১৯৬১ এ এটির পরিকল্পনা গ্রহণ করে , ১৯৭২ সালে প্রকল্পটি শেখ মুজিব বন্ধ করে দেয়।

পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ নৌ-পথে যাত্রী ও মালামাল পারাপারের জন্য এটি তৈরি করা হয়, বর্তমান নাম বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ।

গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প, মংলা সহ দুটি সামুদ্রিক বন্দর গঠন হয় পাকিস্তান আমলে।

তেমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণের পাকা রাস্তা এখানে ছিল না। পূর্ববঙ্গের স্থলপদ ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। রেলপথ যা পাওয়া গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খুব বেশী ব্যবহারের ফলে ইঞ্জিন ও গাড়ীসহ সবগুলো প্রায় ভগ্নদশায় এসে দাঁড়িয়েছিল। নতুন রেলপথ নির্মিত হল ১৫৭ মাইল; ১৯৫২ সালে যেখানে উন্নতমানের পাকা রাস্তা ছিল ৫৯৪ মাইল ও নিম্নমানের পাকা রাস্তা ছিল ১৩২৮ মাইল, সেখানে ১৯৬৯- ৭০ সালের মধ্যে তা উচ্চমান সম্পন্ন পাকা রায় হল ৪,৪৮১ মাইল আর নিম্নমানের পাকা রাস্তা হল ১৮৭৪ মাইল।

একটি রুগ্ন, ভগ্নদশায় থাকা দেশ যার কোন স্থাপনা নাই, রাস্তা নাই , বিদ্যুৎ নাই , কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নাই, ২০০ বছরের গোলামিতে আচ্ছন্ন একটি জাতিকে ২৩ বছরে অবকাঠামোগত ভাবে যতটুকু করা সম্ভব তার সবটুকুই হয়েছে পাকিস্তান আমলে।

পূর্ব বাংলার/পাকিস্তানের সামরিক, বেসামরিক, আমলাতন্ত্রিক স্থাপনা ও জনবল (১৯৪৭-৭১)

ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাংলার মুসলমান জনগনের অবস্থা নিয়ে উইলিয়াম হান্টার তার “দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস” বইয়ে উল্লেখ করেছেন—

“ যে সব হিন্দুরা এক সময় নিম্ন পদের চাকুরিতে নিযুক্ত ছিলেন, নয়া ব্যবস্থার (১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তু) বদৌলতে তারা জমিদার শ্রেণীতে উন্নীত হয়। অভিজাত মুসলমানদের জন্য সেনাবাহিনীতে প্রবেশের দরোজা আমরা (ইংরেজরা) বন্ধ করে দিয়েছি কারণ আমাদের নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে বাইরে রাখা প্রয়োজন আমরা মনে করেছি। সরকারি গেজেটে কর্মখালির যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন তাতে বলা হয় যে, এই শূন্য পদগুলোতে কেবলমাত্র হিন্দুদের নিয়োগ করা হবে। এপ্রিল ১৮৭১ অনুযায়ী সহকারী কমিশনার হিন্দু ৭ জন, মুসলমান ০, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর হিন্দু ১১৩ জন, মুসলমান ৩০ জন, ইনকাম টেক্স প্রসেসর হিন্দু ৪৩ জন, মুসলমান ৬ জন, রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট হিন্দু ২৫জন, মুসলমান ২ জন, মুন্সেফ হিন্দু ১৭৮ জন, মুসলমান ৩৮ জন।”14

স্বাধীনতার পর দেখা গেল পূর্ব বাংলার ডাক্তার, ইন্ঞ্জিনিয়ার, আমলা, পুলিশ , উকিল, জমিদার, বিচারপতি, শিক্ষক, ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৯৫-৯৮% ছিল হিন্দু, তারাও ভারতে চলে যায় দেশভাগের কারণে। ৪৭-এ হিন্দু অফিসারদের দেশ ত্যাগের মহা সংকটে পড়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্ক্রন সরকার।

রেলওয়ে জনশক্তিতে পূর্ব বাংলার মানুষ ছিল প্রায় অনুপস্থিত, রেলগাড়ী চালানোর ড্রাইভারও ছিল না। তখন উত্তর ভারত থেকে আগত মুহাজির অবাঙালি দিয়ে অফিস আদালত, রেল, পোষ্ট অফিসসহ নানা সরকারি দফতর ঢালাতে হয়েছে , উন্নত মানের রেলওয়ে ওয়ার্কসপ তৈরি হল দুইটি ।

এই প্রদেশে (পূর্ব বাংলা/পাকিস্তান) প্রশাসনিক জ্ঞান সম্পন্ন জনশক্তি ও স্থানীয় নেতৃত্ব ছিল না যাদের উপর নির্ভর করে উন্নয়ণ প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া যায়। এখানে ২০/ ২৫ জুন ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং সাব ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন তার একাত্তরের স্মৃতি বইয়ে লেখেন-

“ ১৯৪৭ সালের শেষদিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সেন্ট্রাল সার্ভিসের জন্য অনেক অফিসার রিক্রুট করা হয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা অনুষ্ঠানের সময় ছিল না কারণ তখনই কিছু লোক ট্রেনিং এর জন্য নিয়াগ করার প্রয়োজন দেখা দিল। এ প্রসঙ্গে বলা বোধ হয় প্রয়োজন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাংগালী আই সি এস অফিসার একজনও ছিল না। সুতরাং শুধু ইন্টারভিউ করে কাউকে ফরেন সার্ভিস, কাউকে এডমিনিসট্রেটিভ সার্ভিস, কাউকে অডিট সার্ভিসে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পূর্ব পাকিস্ত্রনের কলেজে কলেজে রিক্রুটমেন্ট টিম ঘুরে বেড়িয়ে লোক সংগ্রহ করে।”15

১৯৪৯-৫০ সালে পাকিস্তানের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, যারা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে এমন বাংলাভাষী ৪০ জনকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন শাখায় নিয়োগ দেয়া হয় সরকারী নির্দেশে। ১৯৪৯/৫০ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মেধা ভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয় ২০ শতাংশ বাকী ৮০ শতাংশ পদ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সমানভাবে তাগ করে দেয়া হয় । ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে সিএসপিদের ৩ বছর সময় অতিক্রান্ত হলে তাদের নিজ প্রদেশে প্রত্যাবর্তন করানো শুরু হয়। ১৯৫৫ সালের প্রাথমিক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান সিএসপির অনুপাত ৩৫ শতাংশে পৌঁছে। দেশ ভাগের সময় যখন অধিকাংশ ডিসি, পুলিশ কর্মকর্তা, রেলকর্মচারী অবাঙ্গালী ১৯৭০ এ চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছিল। প্রায় সবগুলো জেলাতেই তখন বাঙালী অফিসার। এমন কি ১৯৭১ এ ইসলামাদে কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্রেটারিয়েটে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ কর্মচারিহ ছিল পূর্ব পাকিস্তানী। ১৯৭১ ঢাকার পতনের ৪ লক্ষ বাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পড়েছিল তারা বেশীর ভাগই ছিল কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারি বা সামরিক বিভাগে কর্মরত । এমন কি লন্ডন ও নিউয়র্কের পাকিস্তানের দুতাবাদগুলোতে প্রায় অর্ধেক কর্মচারী ছিল বাংলা ভাষী ।

পুলিশ অফিসার এবং কনস্টেবলের সংখ্যা ছিল ন্যূনতম প্রয়োজনের এক পশ্চমাংশ তাড়াতাড়ি করে রাজারবাগে পুলিশ লাইন্স একাডেমি করে পুলিশে পর্যাপ্ত সদস্য নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়৷

সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে। মাত্র ২শ' জন শক্তি নিয়ে একটি সেনা বাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। তখন প্রশাসনিক সামরিক কোন ক্ষেত্রেই পূর্ব বাংলা স্বনির্ভর হওয়ার মত প্রয়োজনীয় পরিমাণ দক্ষ জন শক্তি ছিল না। সেনাবাহিনীতে বাংলাভাষীদের সংখ্যা অতি নগণ্য হওয়ার ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। বৃটিশ আমলে বাংলাভাষী মুসলমানদেরকে সেনাবাহিনীতে নেয়া হতোনা। আবার বাঙালি মুসলমানরাও বৃটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে খুব একটা যেতোনা। প্রাকৃতিক কারণে নাতিশীতোষ্ণমন্ডলের মানুষগণ যোদ্ধা হয় না। সাধারণত যোদ্ধা হয় রুক্ষ অঞ্চলের মানুষগণ। সেই হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের বেশিরভাগ অঞ্চলের মানুষ ঐতিহাসিকভাবে যোদ্ধা জাতি। আগে থেকেই সেনাবাহিনীতে তাদের উপস্থিতি ছিল বেশি।

তখন কোন উন্নত মানের ক্যান্টনমেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে ছিল না । আইয়ুব খান ১৯৪৮ সালে জানুযারীতে যখন পূর্ব পাকিস্তানের জিওসির দায়িত্ব প্রাপ্ত হলেন তখন এখানে সেনা বাহিনীর মাত্র ৫টি কোম্পানী সহকারে দুটো ব্যাটেলিয়ান ছিল। জেনালের আইয়ুব তার আত্মজীবনী 'ফ্রেন্ডস নট মাষ্টার' গ্রন্থে লিখেছেন-

“সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে কোন টেবিল চেয়ার বা ষ্টেশনারী ছিল না বলতে গেলে আমাদের কিছু ছিল না। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের একটি মানচিত্র পর্যন্ত ছিল না।”16

১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের দুই জন অফিসারের নাম উল্লেখ করার মত হয়ে উঠে এর একজন ছিলেন কর্ণেল ওসমানী এবং আর একজন ছিলেন মেজর গনি । মেজর আব্দুল গণিকে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ডকিং সুবিধা সহ একটি নেভাল বেজ চট্টগ্রামে স্থাপন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের তরুণদের রিক্রুটের জন্য একটি ডিপো, অনেক বিক্রুটিং সেন্টার এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনা করা হয়। অন্য আর একজন পূর্ব বাংলার কর্নেল আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরীকে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণদের যুগোপযোগী দক্ষ হিসাবে ভবিষ্যত নেতৃত্বের জন্য গড়ে তোলার ব্যাপারে ক্যাডেট কলেজ স্থাপনের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে উন্নত মানের ক্যান্টনমেন্ট তৈরি করা হয় ।

১৯৬৯ থেকে ৭১ সালের মধ্যে ৪টি রেজিমেন্ট গড়ে তোলা হয় শুধু মাত্র পূর্ব পাকিস্তানীদের নিয়ে। এর উপরে পাঞ্জাব, বেলুচ এবং এবং ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্ট গড়ে তোলার সময় ২৫ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানীকেও রিক্রুট করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানীদের এত দ্রুত নিয়োগ দেয়া হচ্ছিল যে ঢাকার ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার সেনাবাহিনীর মান হ্রাস হওয়ার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে।

১৯৪৭ সালে এখানে কয়েকজন কমিশন অফিসার ৫০/৬০ জন জুনিয়ার কমিশন এবং ২০০ জন জোয়ান ছিল। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩ লক্ষ সদস্যের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার।

ইতিহাসের আলকে আমরা যদি সামরিক, বেসামরিক ও আমলাতান্ত্রিক অবস্থার এক কথায় সারসংক্ষেপ করি তাহলে একথা বলতে কোন দ্বিধা নাই যে আমরা এসব কিছুই পেতাম না যদি পাকিস্তান না হত । রাষ্ট্রিয় সামরিক প্রতিষ্ঠানের বুনিয়াদি সকল কিছুই পাকিস্তান আমলের তৈরি ।

পূর্ব বাংলার/পাকিস্তানের কৃষি ও শিল্প খাত (১৯৪৭-৭১)

১৯৪৭ এ জনসংখ্যার অধিকাংশই ছিলেন আধা-সর্বহারা কৃষক বা সর্বহারা মুসলমান । এখানকার সব জমিদার, ব্যবসায়ী, মহাজন প্রায় সবই ছিল হিন্দু। এমনকি এ অঞ্চদের একমাত্র অর্থকরী ফসল পাট ব্যবসাটিও হিন্দু মাড়ওয়ারীদের হাতেই ছিল। বাংলা বিভক্তির পর তারা পুঁজি ও অর্থসহ ভারতে চলে যায়। কয়েক হাজার সম্পদশালী হিন্দু পরিবার পূর্ববঙ্গ থেকে চলে যাওয়ার ফলে শুধু যে পর্ববঙ্গের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছিল তাই নয়, সে বিপর্যন্ত অর্থনীতির পাশাপাশি ভারত থেকে আসতে থাকল লক্ষ লক্ষ মুহাজির , নিঃস্ব বাস্তুত্যাগী মানুষের ঢল, যার সংখ্যা সরকারী হিসাবেই সাত লক্ষ বলা হল।

বৃটিশ ভারতে আদতে শিল্পের দিক থেকে পূর্ববঙ্গ পুরিপূর্ণভাবেই অবহেলিত ছিল । একমাত্র অর্থকরী ফসল পাট বিন্তু বাংলার ৬৮,২৫৮টি তাঁত সম্বলিত ১১৩টি পাটকলের মধ্যে একটি পাটকলও পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে ছিল না। কোন প্রকাশনা শিল্প, আধুনিক ছাপাখানা এমন কি ব্লক তৈরীর কোন ব্যবস্থাও ছিল না। পূর্ববাংলা র ভাগে চাষযোগ্য জমি পড়েছিল সর্বমোট দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ একরের মত, যার মধ্যে ঐ সময়কালে এক কোটি অশি লক্ষ একরের মত চাষ করা সম্ভব হত; আর এর মধ্যে আঠার লক্ষ একরের মত পাট চাষযোগ্য জমি ছিল। বনসম্পদ পড়েছিল রাজস্ব আদায়ের অনুপাতে সমগ্র বাংলার বন সম্পদের ১৩ ভাগের ৪ ভাগ। আর এখানে খাদ্যশস্য যা উৎপন্ন হত তা আবার এই প্রদেশের জনসংখ্যার প্রয়োজনের তুলনায় ছিল কম; তাই ছিল খাদ্য ঘাটতি সমস্যা।

১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ৪টি বঙ্গকল ছিল। সেগুলো হল ঢাকা জেলার চিত্তরঞ্জন কটন মিলস, লক্ষীনারায়ন কটন মিলস, ঢাকেশ্বরী কটন মিলস এবং কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলস।

৪টি চিনি কল ছিল । এগুলো হল কুষ্টিয়া জেলার দর্শনার কেরু কোম্পানী, রাজশাহী জেলার গোপালপুরের উত্তরবঙ্গ সুগার মিলস, রংপুরের মহিমগঞ্জ সুগার মিলস এবং সেতাবগঞ্জের ইষ্টবেঙ্গল সুগার মিলস। এ অঞ্চলে আর কোন শিল্পকারখানাই ছিল না।

পাকিস্তান আমলে কৃষি, অর্থনৈতিক ও শিল্প উন্নয়নের ফিরিস্তি বর্ণনা পাওয়া যায় আমিনুল হকের লেখায় –

“১৯৭০ সালের মধ্যে ২৪, ৩৩৪টি লুম সম্বলিত ৬৮টি পাটকল স্থাপিত হল, ১৯৪৭ সালে যেখানে ২৬০০ লুম ও ১, ১২, ০০০ স্পিন্ডল সম্বলিত মাত্র ৭টি কাপড়ের কল ছিল সেখানে । ১৯৭০ সালের মধ্যে তা ৭,০০০ লুম ও ৭,৫০,০০০ স্পিন্ডল সম্বলিত ৪৪টি কাপড়ের কলে উন্নীত হয়। চিনিকল ১৯৭০ সালের মধ্যে ১৫টিতে উন্নীত হল: ম্যাচ ফ্যাক্টরীর উৎপাদন ক্ষমতা যেখানে সমগ্র পাকিস্ত্রনে ১৯৪৭ সালে ছিল ৮০ লক্ষ্য গ্রাস বাক্স, শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানেই ১৯৭০ সালে উৎপাদন হল ১১৩ লক্ষ গ্রস বাক্স; খুলনায় তৈরী হল শিপইয়ার্ড, নারায়ণগঞ্জে ডক ইয়ার্ড নির্মিত হল, স্টিল মিল হল একটি, গালফ্রণ হাবিব নামে জুট মিল স্পেয়ারস তৈরির কারখানা হল, আরডন্যানস ফ্যাক্টরী হল, রসায়ন শিল্প হল; দুইটি কাগজ কল, একটি নিউজপ্রিন্ট মিল ও একটি হার্ডবোর্ড মিল হল; বৃহৎ মুদ্রণ শিল্প স্থাপিত হল; সার কারখানা হল; গাড়ী সংযোজন কারখানা হল, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরী হল, ইলেট্রিকাল ইকুইপমেন্ট তৈরির কারখানা হল; বাই-সাইকেল সংযোজন তৈরি কারখানা হল, তৈল শোধনাগার হল; যেখানে কোন সিগারেট ফ্যাক্সরী ছিল না সেখানে সিগারেট ফ্যাক্টরীর উৎপাদন ১৯৬৯-৭০ সালে এক হাজার সাত শত কোটি সিগারেট-এ উন্নীত হল; ১৯৬৯-৭০ সালে কস্টিক সোডা উৎপাদন হল ৩, ৩৫০ টন, সালফিউরিক এসিড উৎপাদন হল ৬, ৪৫০ টন, ক্লোরিন উৎপাদন হল ২, ৯০০ টন, বাস, ট্রাক, কার ও জীপ এসেম্বিং হল ৪৫৫টি, ইউরিয়া ফার্টিলাইজার উৎপাদন হল ৯৬, ০০০ টন; চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরের মাধ্যমে ১৯৬৭-৬৮ সালে রপ্তানী হয়েছিল ১৪ লক্ষ টনের উপর এবং আমদানী হয়েছিল ৪২ লক্ষ টনের উপর মালামাল; ১৯৪৭ সালে সমগ্র পাকিস্ক্রনে কার, জীপ, ট্যাক্সী, বাস, ট্রাক,ব্যাবিট্যাক্সী, মোটর সাইকেল প্রভৃতি রাস্তায় চালিত যানের সংখ্যা ছিল ২৫,৪৩৫ তা ১৯৭০ সালের মধ্যে শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ৭০,০৮৬টিতে উন্নতি হয়েছিল: ১৯৪৭ সালে সমগ্র পাকিস্তানে টেলিফোনের সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার, তা ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে দাঁড়িয়েছিল ৪৫, ৬৫ ৭টিতে; ১৯৬৬ ৭০ সালে কৃষিতে রাসায়নিক স্যার ব্যবহার হল ২, ৭৭, ০০০ টন; পাওয়ার পাম্প ও নলকূপের সাহায্যে পানি সেচের ব্যবহার হল ঐ বছর ৮ লক্ষ একরেরও বেশী জমিতে। বিদ্যুৎ, রাস্তা, যোগাযোগ, পরিবহণ, সেচ, বন্দর প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়নের পাশাপাশি প্রায় ১৫০টি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। তাছাড়া রেল, নৌ ও সড়ক পরিবহন শিল্পের উন্নতি নিশ্চয়ই সামন্ততান্ত্রিক কায়দায় শোষণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৬৯-৭০ সালে শুধুমাত্র রেলওয়েতে চালান দেওয়া মালের ওজন ছিল ৪৮ লক্ষ টন।

এর পাশাপাশি ১৯৪৭ সালে মাত্র ৭,৭০০ একরের চা বাগান শিল্প উন্নীত হয়ে ১৯৬৯ সালের মধ্যে এক লক্ষ একরে দাঁড়িয়েছিল, জুট প্রেসও প্রায় ৭০টিতে উন্নীত হয়েছিল। এ ছাড়া গড়ে উঠেছিল মাঝারি ও ছোট আকারের অনেক রিরোলিং মিল, ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা, মুদ্রণ, প্রকাশনা ও প্যাকেজিং শিল্প, সংবাদপত্র শিল্প, ঔথষ প্রস্তুত শিল্প, চামড়া শিল্প, পাদুকা উৎপাদন কারখানা, কাঁচের দ্রব্যাদি প্রস্তুত শিল্প, লৌহ কারখানা, ঢালাই কারখানা, এলুমিনিয়াম ফ্যাক্টরী, মেরামত কারখানা ও ডকইয়ার্ড, ইট তৈরি শিল্প, ফার্নিচার তৈরি শিল্প, স-মিল, আটা-চাল তৈল ডাল ভাঙ্গান কল, ময়দা শিল্প, লবণ তৈরি কারখানা, বিস্কুট ও বেকারী শিল্প, প্লাষ্টিক ও রাবার শিল্প, টায়ার উৎপাদন শিল্প, হোসিয়ারী শিল্প, ইলেট্রিক তার, বাহু, পাখা ইত্যাদি তৈরি শিল্প, মৎস প্রক্রিয়াজাতকরণ ও আলু হিমায়িতকরণ শিল্প, প্রসাধনী সামগ্রী প্রস্তুত শিল্প, ব্যাটারি উৎপাদন শিল্প, সাবান কারখানা, পিচবোর্ড ও কাগজের দ্রব্য প্রস্তুত কারখানা, বিভিন্ন ধরনের সংযোজন ও মেরামত কারখানা, পোশাক তৈরি শিল্প প্রভৃতি কয়েক হাজার শিল্প যার মধ্যে ১৯৭০ সালে সরকারীভাবে রেজিস্ট্রিকৃত ছিল সাড়ে তিন হাজরের উন্দ্রা, আর চীফ ইনসপেক্টর অব ফ্যাক্টরীজ এন্ড ইষ্টাবলিশমেন্টস- এর ১৯৬৯ সালের রেকর্ড অনুযায়ী ছিল ৫, ৫৪১টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। ১৯৭০ সালে চলচ্চিত্র গৃহের সংখ্যা ছিল ১৬৬টি। আরও ছিল অগণিত হস্তচালিত তাঁত (সরকারীভাবে স্বীকৃত হ্যান্ডলুম ফ্যাক্টরী ছিল প্রায় সাড়ে সাত শত) শিল্প ও বিভিন্ন কুটির শিল্প, অলংকার প্রস্তুত শিল্প, বিড়ি তৈরি কারখানা, নির্মাণ শিল্প, টেইলারিং সপ, বই বাঁধাই কারখানা ইত্যাদি। যাতে নিযুক্ত ছিল লক্ষ লক্ষ শ্রমিক এর পাশাপাশি ছিল। হাজার হাজার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও দোকান। ছিল ইম্পোর্ট এক্সপোর্ট ব্যবসা, ক্লিয়ারিং- ফরোয়ারডিং ব্যবসা, ক্যারিং ব্যবসা, কনসাল্টিং ফার্ম, ব্যাংক ও বীমা শিল্প ইত্যাদি। ১৯৯৬- ৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আমদানী ও রপ্তানী সময়ে এক টন পাটের গড় রপ্তানী মূল্য ছিল ১. ৫৫৫৩.০০ টাকা ও এক টন কাঁচা পাটের গড় রপ্তানী মূল্য ছিল ১. ২২৩.০০ টাকা এবং এক পাউন্ড চা-র গড় রপ্তানী মূল্য ছিল এক টাকা পঞ্চাশ পয়সার মত।

অসংখ্য সফল স্থাপনা কাপতাইবাধ, চট্টগ্রামকে প্রধান সামুদ্রিক বন্দর হিসাবে প্রতিষ্ঠা, চন্দঘোনা পেপার মিল, ফেছুগঞ্জ সার কারখানা যা পাকিস্তানের যে কোন স্থানে নির্মিত হতে পারত। কিন্তু সেটা ছিলো কেন্দ্রের উদ্যোগ। কেন্দ্রের উদ্যোগে প্রাইভেট সেক্টরেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।

হিন্দু সাংসদদের বিরোধিতা সত্ত্বেও মুসলিম রায়তদের মালিকানা স্বত্ব প্রদান করা হয়। স্থবির সব সেক্টরে প্রাণ চাঞ্চল্যের সূচনা করা হয়েছিল এমন ভাবে যে কোন দুর্ভিক্ষই তার কালো হাত বাড়াতে পারেনি। ঘাটের দশকে পূর্ব বাংলা খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়।”17

পূর্ব বাংলার এই স্বাধীন ভূমি পাকিস্তান আমলে এক শতাব্দীর চতুর্থাংশ অর্থাৎ ২৫ বছরের মধ্যে যেভাবে অগ্রগতির নতুন দিগন্ত রচনা করেছে অতীতের লম্বা ইতিহাসের কোন পর্যায়েই এমন অগ্রগতি অর্জিত হয়নি।

বাংলাদেশের এই ভূমির কৃষি ও শিল্পায়নের যুগ যদি তিনটি ধরা হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশ আমল, পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশ আমল। তাহলে চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরের অগ্রগতি যেকোনো সময়ের চেয়ে অত্যধিক ও সময়োপযোগী । একটি কাঙ্গাল অর্থব্যবস্থা থেকে সেটিকে দাড় করিয়ে দিয়ে আমাদেরকে উন্নয়নের রাস্তায় উঠিয়েছে পাকিস্তান।

আমরা এই লেখার এখন উপসংহারে ; প্রমাণিত সত্য এটাই যে বৃটিশ আমলে বাংলাদেশে আমাদের অবস্থান আর পাকিস্তান আমলে আমাদের অবস্থানের পার্থক্য হিমালয় সমান সুউচ্চ। একাত্তরের পর বাংলাদেশ যে রাষ্ট্রীয় ভিত্তি পেয়েছে, তার শিক্ষা, অর্থনীতি, শিল্প, কৃষি, বিদ্যুৎ, আমলাতন্ত্র, সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী সবগুলোই পাকিস্তানের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। এই জাতিকে ইতিহাসের নামে যেভাবে পাকিস্তান আমলকে ঘৃণা ও বৈষম্যের পর্দায় আবৃত করে রাখা হয়েছে সেই বৈষম্যগুলো কোনটিই পাকিস্তান আমলের তৈরি নয় ,সবগুলো উপনিবেশ আমলের যেখানে পাকিস্তান এই বৈষম্যগুলোকে কমিয়েছে ব্যাপকহারে । অথচ একতরফা ভাবে পাকিস্তানকে দায়ী করা হয় । এসব যে দ্বিউপনিবেশিত ও কোলকাতা রেনেসাঁয় উজ্জীবিত মস্তিষ্কের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতরামি , চাপাবাজি ও সুস্পষ্ট রাজনৈতিক মিথ্যাচার তা বুঝতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নাই। পাকিস্তান আমলে ইসলামবিদ্বেষী বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদীরা যেসমস্ত মনগড়া, ভিত্তিহীন, অসত্য তথ্য দিয়ে জাতির চিন্তার কাঠামোকে কলুষিত করেছে তা থেকে উদ্ধার হওয়া এখন সময়ের দাবী। এ লেখায় আমরা দেখানোর চেষ্টা করেছি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সমস্ত বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠান তৈরি ও প্রশিক্ষিত হয়েছে পাকিস্তান আমলে রুগ্ন, বেহাল, নিষ্পেষিত, গোলামদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে জ্ঞাতি মুসলমান ভাইদের কল্যাণে অর্থাৎ পাকিস্তান শাসনামলে । পাকিস্তান আমলকে বিচার করতে চাইলে অবশ্যই ১৯৪৭ কে সামনে নিয়ে তুলনা করতে হবে তখন আমাদের কি ছিল, কোন কোন প্রতিষ্ঠান ছিল, কতটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল, কতজন মানুষ শিক্ষিত ছিল, অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও শিল্পায়নের পরিমানের অবস্থা কি ছিল, কিংবা সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক কাঠামোতে কতজন মানুষ যোগ্য ছিল আর পাকিস্তান আমল আমাদের কি কি দিয়েছে তাহলেই জ্ঞানী ও চিন্তাশীল মন যৌক্তিক কিছু উত্তর খুঁজে পাবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি।

তথ্যসূত্র

  1. Quaid-i-Azam Mahomed Ali Jinnah Speeches, as governor general of Pakistan 1947-1948. Karachi: Pakistan Publication

  2. Quaid-i-Azam Mahomed Ali Jinnah Speeches, as governor general of Pakistan 1947-1948. Karachi: Pakistan Publication

  3. ফাহমিদ-উর-রহমান, আ মরি বাংলা ভাষা, প্রতীতি প্রকাশনী, ঢাকা, ২০২৩

  4. শাহাবুদ্দিন আহমদ, আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল, বুকস ফেয়ার, ঢাকা, ২০০৪

  5. শাহাবুদ্দিন আহমদ, আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল" বুকস ফেয়ার, ঢাকা, ২০০৪

  6. আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, খোশরোজ কিতাব মহল, ঢাকা ।

  7. মেজর রফিকুল ইসলাম, স্বাধীনতার সংগ্রামে আওয়ামীলীগের ভূমিকা (আবু নিশাত চৌধুরি, আমাদের স্বাধীনতা; পর্দার এপার ওপার)

  8. আবু নিশাত চৌধুরি, আমাদের স্বাধীনতা; পর্দার এপার ওপার

  9. অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ১৯৮২।

  10. ড সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, একাত্তরের স্মৃতি, ১৯৯৩

  11. কে এম আমিনুল হক, আমি আল বদর বলছি।।

  12. ফিরোজ মাহবুব কামাল, একাত্তরের আত্মঘাতের ইতিহাস ।

  13. সাংবাদিক এইচ. এম আব্বাসী, কলামিস্ট, পাকিস্তান।

  14. উইলিয়াম হান্টার, দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস, ১৯৮২

  15. ড সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, একাত্তরের স্মৃতি, ১৯৯৩

  16. মোহাম্মদ আইয়ুব খান, ফ্রেন্ডস নট মাষ্টার; একটি রাজনৈতিক আত্মজীবনি, দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০৮।

  17. কে এম আমিনুল হক, আমি আল বদর বলছি।