
অ্যাডাম স্মিথের পূর্ববর্তী অর্থনীতি চিন্তার যুগ : মুসলিম পণ্ডিতদের লেখনীতে অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা
অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান খোঁজা মানবসভ্যতার একটি প্রাচীন ও মৌলিক চিন্তার বিষয়, যা সমাজের টিকে থাকা ও উন্নয়নের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এই চিন্তাভাবনা থেকেই বিভিন্ন সময়, পরিবেশ ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন অর্থনৈতিক চিন্তার স্কুল বা মতবাদ। মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগেও অর্থনৈতিক বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও চিন্তাধারা গড়ে উঠেছিল। মুসলিম পণ্ডিতদের অর্থনৈতিক চিন্তার যুগকে সাধারণভাবে তিনটি বিস্তৃত শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
প্রথম পর্যায়কাল : গঠনকাল (the formation period) (১১-১০০ হিজরি/৬৩২-৭১৮ খ্রিস্টাব্দ)
এই পর্যায়কালে মুসলিম পণ্ডিতগণ বিভিন্ন বই রচনা করেছেন যেগুলো অর্থনৈতিক চিন্তায় অসামান্য অবদান রেখেছে। এই সময়ে ইমাম আবু ইউসুফ এবং মুহাম্মদ আল-শায়বানী যথাক্রমে কিতাব আল-খারাজ এবং কিতাব আল-কাসব লিখেছেন। ইয়াহিয়া বিন আদম আল-কুরাশি কর (tax) এবং অন্যান্য আর্থিক বাধ্যবাধকতা (financial obligations) সম্পর্কিত রাসুল (সঃ) এর হাদীস সংকলন করেছেন, যার উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে আবু উবায়দ আল-কাসিম বিন সাল্লাম এবং পরে তার ছাত্র ইবনে-জাঞ্জাওয়ায়েহ কিতাব আল-আমওয়াল রচনা করেছেন। ইবনে আবি আল-দুনিয়া ইসলাহ আল-মাল এবং আবু বকর আল-খাল্লাল সম্পর্কে সাধারণভাবে ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কে লিখেছেন।
এই সময়ের মধ্যে যে ধরণের অর্থনৈতিক ধারণাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পেয়েছে তার একটি অসম্পূর্ণ তালিকা নিম্নরূপ: বাজার এবং এর নিয়ন্ত্রণ, যোগান এবং চাহিদা, মূল্য নির্ধারণ, অর্থ, ঋণ এবং ঋণের উপকরণ, সুদ এবং পণ্য বিনিময়, কর, সরকারি অর্থায়ন, রাজস্ব নীতি, বিভিন্ন ধরণের ব্যবসায়িক সংগঠন, কৃষি সম্পর্ক, যাকাত, উত্তরাধিকার, সম্পত্তি, দারিদ্র্য এবং সম্পদ।
দ্বিতীয় পর্যায়কাল : অনুবাদ সময়কাল (দ্বিতীয়-পঞ্চম হিজরি শতাব্দী /অষ্টম-একাদশ খ্রিস্টশতাব্দী)
এই পর্যায়কালকে তিনটি স্বতন্ত্র ধারায় বিশ্লেষণ করা যায়।
ক. গ্রীক দর্শনের পূর্ণাঙ্গ প্রত্যাখ্যানকারী ধারা
এই ধারার অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে, নিরাপদ ও পরিতৃপ্ত জীবন যাপনের জন্য ইসলামী জ্ঞান-ঐতিহ্যই যথেষ্ট; গ্রীক দর্শন ও যুক্তিবাদী চিন্তার প্রতি তাদের কোনো নির্ভরতা ছিল না। তারা ইসলামী পরম্পরাগত জ্ঞানের উপরই পূর্ণ আস্থা রাখতেন এবং মূলত কোরআন, হাদিস ও ফিকহের আলোকে চিন্তাভাবনা পরিচালনা করতেন। এই ধারার চিন্তাবিদদের 'ঐতিহ্যবাদী' বা 'মুহাদ্দিসুন' নামে অভিহিত করা হয়। এই দলের অন্যতম প্রধান প্রতিনিধিরা হলেন—আল-কিনানী, আল-ফাররা, আল-সারখসী প্রমুখ।
খ. মধ্যপন্থী চিন্তাধারা
এই দলটির পণ্ডিতগণ উপকারী ও গ্রহণযোগ্য ধারণা এবং ইসলামী বিশ্বাস ও নীতির পরিপন্থী ধারণার মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য নির্ণয়ের চেষ্টা করেছিলেন। দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে তারা গ্রীক দর্শনের ওপর ইসলামী চিন্তাধারার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। তবে যখন এ দুই ধারার মধ্যে সামঞ্জস্য ও সংশ্লেষণ সম্ভব হয়েছে, তখন তারা তা করার চেষ্টাও করেছেন। এই ধারার পণ্ডিতগণ ছিলেন যুক্তিবাদী ও ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনায় পারদর্শী। তারা বিভিন্নভাবে ইসলামী পণ্ডিত, ধর্মতত্ত্ববিদ বা মুতাকাল্লিমুন নামে পরিচিত। এই দলের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিগন হলেন—আল-মাওয়ারদী, আল-গাজ্জালী, ফখর আল-দীন আল-রাজী প্রমুখ।
গ. দর্শন-প্রভাবিত ধারা
এই দলটির অন্তর্গত পণ্ডিতগণ গ্রীক দর্শন ও তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তারা এসব ধারণা শুধু গ্রহণই করেননি, বরং সেগুলোর প্রচার ও প্রসারের দিকেও অগ্রসর হয়েছেন। ইসলামী প্রবন্ধ ও ভাবনাকে তারা এমনভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন যাতে গ্রীক দর্শনের জটিল ও বিচিত্র তত্ত্বসমূহের জন্যও সেখানে স্থান তৈরি হয়। এই ধারার পণ্ডিতদের ‘মুসলিম দার্শনিক’ বা ‘হুকামা’ নামে অভিহিত করা হয়। এই দলের বিশিষ্ট সদস্যরা ছিলেন—ইবনে সিনা, ইবনে আল-হাইথাম, ইবনে তুফায়েল, নাসির আল-দীন আল-তুসি প্রমুখ।
মুসলিম দার্শনিকগণ ঐকনোমিয়া (oikonomia) কে অনুবাদ করেছিলেন ‘ইলম তাদবির আল-মঞ্জিল’ (গৃহস্থালি ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞান) নামে। এটি গ্রীক দর্শনের তিনটি প্রধান শাখার একটি, অন্য দুটি ছিল—ইলম আল-আখলাক (নীতিশাস্ত্র) এবং ইলম আল-সিয়াসাহ (রাষ্ট্রনীতি বা রাজনীতি)। এইভাবে, অনুবাদ যুগে মুসলিম চিন্তাবিদদের অর্থনৈতিক চিন্তাধারায় গ্রীক দর্শনের বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাব, গ্রহণ, প্রত্যাখ্যান এবং সমন্বয়ের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
তৃতীয় পর্যায় : পুনঃঅনুবাদ এবং প্রেষণের (transmission) সময়কাল
এই পর্যায়টি সেই সময়কে নির্দেশ করে, যখন গ্রীক-আরব ইসলামী চিন্তাধারাগুলি অনুবাদ ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক যোগাযোগের মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশ করে (ষষ্ঠ–নবম / দ্বাদশ–পঞ্চদশ শতাব্দী)। অ্যরিস্টটলের অর্থনীতি চিন্তার বেশিরভাগ দিক পাওয়া যায় তার Politics এবং Nicomachean Ethics গ্রন্থদ্বয়ে। এই দুটি রচনার উপর মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদের (Ibn Rushd) ভাষ্য এবং বিশ্লেষণসমূহের অনুবাদ পাশ্চাত্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই যুগে মুসলিম পণ্ডিতদের চিন্তা-পদ্ধতি ইউরোপীয় পুনর্জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং ইউরোপীয় দর্শন ও অর্থনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশে এক ধরনের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে।
মুসলিম পণ্ডিতদের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা (thoughts) : অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনায় ইসলামী ঐতিহ্য (Islamic Tradition)
(১) মূল্য (Price), বাজার (Market) ও মূল্য নির্ধারণের (Price Determination) তত্ত্ব
অর্থনীতি একটি স্বতন্ত্র বিদ্যায় পরিণত হওয়ার পর থেকে ‘মূল্য’ (price) বিষয়টি ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব লাভ করেছে। আধুনিক অর্থনৈতিক চিন্তায়, অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith, 1723–1790) শ্রমের উপর ভিত্তি করে মূল্যের একটি তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন (labour theory of value), কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি উৎপাদন ব্যয়-ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণের তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন (Roll, 1974, p. 162)। ডেভিড রিকার্ডো (David Ricardo, 1772–1823) স্মিথের তত্ত্বের অসঙ্গতি দূর করার চেষ্টা করেন, তবে তিনিও সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে পারেননি । কার্ল মার্কস (Karl Marx, 1818–1883) তার ‘শোষণের তত্ত্ব’ (theory of exploitation) উপস্থাপন করে স্মিথ এবং রিকার্ডোর শ্রম-মূল্য তত্ত্বকে একটি চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন, যা বহু দিক থেকে বিতর্কের জন্ম দেয় ।
পরবর্তী কালে প্রান্তিকবাদীরা (marginalists) মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে চাহিদা ও উপযোগের উপর ভিত্তি করে বিকল্প তত্ত্ব উপস্থাপন করেন (subjective theory of value)—যা ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদদের যোগান-ভিত্তিক তত্ত্বের বিপরীতে দাঁড়ায়। নব্য-ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদরা (neo-classical economists) চাহিদা ও যোগান উভয় উপাদানকে একত্র করে মূল্য নির্ধারণের বিতর্ক সমাধানের চেষ্টা করেন।
ইসলামী চিন্তায় মূল্য নির্ধারণে প্রান্তিক উপযোগ তত্ত্বের প্রতিধ্বনি
ইসলামী চিন্তাবিদগণ ‘প্রান্তিক উপযোগ’ (marginal utility) বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক পরিভাষা ব্যবহার না করলেও তাদের অনেক বক্তব্যে এ ধারণার প্রতিফলন দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ইবনে আব্দুস সালাম ইমাম শাফিঈর একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করে বলেন: “একজন দরিদ্র ব্যক্তি একটি দিনারের মূল্য অনেক বেশি উপলব্ধি করে, যেখানে একজন ধনী ব্যক্তি তার সম্পদের কারণে শত শত দিনারকেও তেমন গুরুত্ব দেয় না” একই ধারণা আল-জুয়াইনির (al-Juwayni) রচনাতেও পাওয়া যায় । আল-শায়বানী (al-Shaybani) ‘অব্যবহার্যতা’ (disutility) ধারণাটিকে স্বীকৃতি দেন, কারণ তিনি বলেন:
“…একজন ব্যক্তি নিজের উপযোগের জন্য খায় এবং যখন তার পেট ভরে যায়, তখন অতিরিক্ত খাওয়ায় কোনো উপযোগ থাকে না; বরং সেখানে অব্যবহার্যতা (অকার্যকারিতা) তৈরি হয়।”
উপযোগের বিষয়গত প্রকৃতি ইবনে আল-জাওযী (Ibn al-Jawzi) আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন:
“খাদ্য ও পানীয় থেকে আনন্দ পাওয়ার পরিমাণ নির্ভর করে একজন ব্যক্তি কতটা তৃষ্ণার্ত বা ক্ষুধার্ত তার উপর। যখন সে তৃপ্ত হয়, তখন অতিরিক্ত খাওয়া কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে।”
আল-দিমাশকী (al-Dimashqi), একজন প্রাচীন মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক, প্রান্তিক উপযোগের হ্রাস সম্পর্কিত ধারণার ভিত্তিতে যুক্তি দেন যে,
“একটি চাহিদা পূরণের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা এবং অপর একটি চাহিদাকে উপেক্ষা করা অযৌক্তিক।”
তিনি আয়ের এমন বণ্টনের পক্ষে মত দেন, যা আধুনিক অর্থনীতির equimarginal principle বা equal marginal utility per unit of expenditure-এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
এভাবে দেখা যায়, ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তায় মূল্যের ধারণা, চাহিদা ও উপযোগের বিষয়টি অনেক আগেই চিন্তাভাবনার অংশ ছিল, যা পরবর্তী ইউরোপীয় অর্থনৈতিক তত্ত্বের সঙ্গে দারুণভাবে সংগতিপূর্ণ।
মূল্য ও দাম তত্ত্ব
মূল্যের উৎপাদন খরচ তত্ত্ব : ইবনে তাইমিয়া (১৯৬৩, খণ্ড ৩০, পৃ. ৮৭) মনে করেন যে “মূল্য হলো শ্রম ও মূলধন উভয় থেকে উৎপন্ন বৃদ্ধি। তাই এই বৃদ্ধি উভয় উপকরণের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া উচিত।” তার আরেকটি বক্তব্যে দেখা যায়, তিনি মূল্যকে জল, বায়ু, কাঁচামাল, শ্রম এবং মূলধনসহ সকল উপাদানের সম্মিলিত ফলাফল হিসেবে বিবেচনা করেছেন । এর অর্থ, ইবনে তাইমিয়া একটি মূল্যের উৎপাদন খরচ তত্ত্ব (cost-of-production theory of value) মেনে চলেছেন।
মূল্যের শ্রম তত্ত্ব : অপরদিকে, ইবনে খালদুন একটি মূল্যের শ্রম তত্ত্ব (labour theory of value) জোর দিয়ে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, “লাভ হলো শ্রম থেকে প্রাপ্ত মূল্য” (১৯৬৭, খণ্ড ২, পৃ. ২৭২)। অন্য এক স্থানে তিনি উল্লেখ করেন, “...এটাও জানা উচিত যে একজন ব্যক্তি যে মূলধন অর্জন করেন এবং সঞ্চয় করেন, যদি তা কোনও শিল্প থেকে আসে, তবে তা হলো তার শ্রম থেকে প্রাপ্ত মূল্য” । তিনি আরও বলেন, “এভাবে এটা স্পষ্ট হয় যে লাভ বা মুনাফা পুরোপুরি বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষের শ্রম থেকেই আসে”। এসব বক্তব্যের আলোকে বেক (১৯৯৪, পৃ. ১১৬) যথার্থই বলেন, “ইবনে খালদুনের মতে, প্রতিটি পণ্যের মূল্য সেটিতে সম্পাদিত কাজের পরিমাণের সমান।” যদিও ইবনে খালদুন বিনিময় মূল্য (exchange value) শব্দটি ব্যবহার করেননি, তার বিশ্লেষণমূলক উপস্থাপনা শ্রমভিত্তিক মূল্যচিন্তার দিকেই ইঙ্গিত করে।
(২) বাজার ও মূল্য নির্ধারণ
চাহিদা, যোগান এবং মূল্য : মূল্য নির্ধারণের প্রশ্নটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগেও উত্থাপিত হয়েছিল, কিন্তু তিনি নিজে মূল্য নির্ধারণে অস্বীকৃতি জানান (ইবনে তাইমিয়া, ১৯৭৬, পৃ. ২৫)। চাহিদা ও যোগান (demand and supply) দামের নির্ধারণে ভূমিকা রাখে—এ বিষয়ে সম্ভবত প্রথম সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করেন বিশিষ্ট ফকীহ ইমাম শাফিঈ। আল-কাসানী তাকে উদ্ধৃত করে বলেন, “মানুষের আগ্রহ (চাহিদা) বাড়ে বা কমে এবং কোনো জিনিস কম বা বেশি পরিমাণে (যোগান) পাওয়া যায়—এই দুই বিষয়ে পরিবর্তনের ফলে প্রতিবার দামের ওঠানামা ঘটে”।
ফসলের ফলন ও মূল্য পরিবর্তন—যার মাধ্যমে কৃষি পণ্যের যোগান বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটে—এই বিষয়ে প্রথম বিশ্লেষণ পাওয়া যায় ইবনে আল-মুকাফার লেখায়। যদিও তার মূল লক্ষ্য ছিল কৃষকের জীবনযাত্রা ও সরকারের রাজস্ব (যা ভূমি কর হিসেবে নির্দিষ্ট হারে আদায় হতো) সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা। একই বিষয়ে আবু ইউসুফও খলিফা হারুন আল-রশিদের ভূমি কর সংস্কার পরামর্শে অনুরূপ বিশ্লেষণ প্রদান করেন।
তিনি লিখেছেন,
“স্বল্পতা ও ব্যয়বহুলতার নির্ধারিত কোনো সীমা নেই। এটি স্বর্গীয়ভাবে নির্ধারিত বিষয়; নীতিটি আমাদের জানা নয়। কখনো খাদ্যের প্রাচুর্যেও তা ব্যয়বহুল হয় এবং কখনো খাদ্য স্বল্প হলেও তা সস্তা থাকে। সবই আল্লাহর নির্দেশ ও সিদ্ধান্তের অধীন।”
চাহিদা ও সরবরাহের ভূমিকা সম্পর্কে আরও একটি প্রাথমিক দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায় আল-জাহিজ-এর রচনায় (আল-তাবাসসুর বিল-তিজারাহ)। তিনি বলেন:
“যখন পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তখন সবকিছু সস্তা হয়, কিন্তু যখন জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, তখন তার মূল্য বেড়ে যায়”।
কাজী আবদ আল-জাব্বার (১৯৬৫, খণ্ড ২, পৃ. ৫৫) কিছু চাহিদা ও সরবরাহের কার্যক্রম ব্যাখ্যা করেন এবং সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তাকে চূড়ান্ত কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি আহ্বান জানান যে, বাজার শক্তির ফলে যে পরিবর্তন ঘটে এবং মানুষের হস্তক্ষেপের ফলে যে পরিবর্তন দেখা যায়, তার মধ্যে পার্থক্য করতে হবে এবং প্রয়োজনে সেই হস্তক্ষেপ প্রতিহত করতে হবে।
আল-জুওয়াইনি (১৯৫০, পৃ. ৩৬৭) মনে করেন, চাহিদা ও সরবরাহের বৃদ্ধি ও হ্রাসের মাধ্যমে মূল্য নির্ধারিত হয়, যা ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তিনি মনে করেন, এখানে এমন একটি সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার (perfectly competitive market) বিদ্যমান, যেখানে কোনো ব্যক্তি (ক্রেতা বা বিক্রেতা) দাম নির্ধারণ করতে সক্ষম নয়—অর্থাৎ সবাই মূল্য গ্রহীতা (price taker), মূল্য নির্ধারক (price maker) নয়।
তার শিষ্য ইমাম আল-গাজ্জালি (খণ্ড ৩, পৃ. ২২৭) বাজার বিকাশের উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যা স্বেচ্ছাসেবী বাণিজ্য (voluntary commercial activity) এবং চাহিদা ও সরবরাহের শক্তি (demand and supply forces) দ্বারা পরিচালিত। তার মতে, বাজার একটি প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার অংশ হিসেবে বিকশিত হয়—পারস্পরিক চাহিদা পূরণের জন্য মানুষের স্বপ্রণোদিত ইচ্ছার মাধ্যমে। বিনিময়ের পারস্পরিকতা (reciprocity of exchange) বজায় রাখতে শ্রম বিভাজন (division of labour) এবং বিশেষায়ন (specialization) আবশ্যক, যা অঞ্চল এবং সম্পদের পার্থক্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। বাণিজ্যিক কার্যক্রম পণ্যকে যথাযথ স্থান ও সময়ে উপলব্ধ করে, ফলে তার মূল্য বৃদ্ধি পায়। বাজারে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের স্বার্থ লাভপ্রত্যাশী মধ্যস্থতাকারী (profit-motivated intermediaries) ও ব্যবসায়ী সৃষ্টির দিকে পরিচালিত করে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাজার বিকাশ নিয়ে এত সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ থাকা সত্ত্বেও, আল-গাজ্জালি সরাসরি চাহিদা ও সরবরাহের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেননি। তবে, উচ্চ খাদ্য মূল্যের বিষয়ে তিনি স্পষ্টভাবে বাজার শক্তি (market forces) সম্পর্কে সচেতনতা প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি বলেন, চাহিদা কমিয়ে মূল্য হ্রাস করা উচিত।
(৩)বাজার ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে ত্রুটি (Imperfections in Market and Price Regulation)
প্রশাসনিক মূল্য নির্ধারণের বিরোধিতা ও বিশ্লেষণ : প্রশাসনিকভাবে দাম নির্ধারণের বিরোধিতা করলেও আল-মাকদিসি (১৯৭২, খণ্ড ৪, পৃ. ৪৪–৪৫) এই বিষয়ে একটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ প্রদান করেন এবং এই ধরনের হস্তক্ষেপের নেতিবাচক প্রভাব তুলে ধরেন। তার মতে, দাম নির্ধারণের চেষ্টা প্রায়শই উদ্দেশ্যের বিপরীত ফলাফল ডেকে আনে। যেমন—“বাহিরের ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য নিয়ে আসবে না, যদি তারা বাধ্য হয়ে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কম দামে বিক্রি করতে হয়; এবং যেসব স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে মজুত পণ্য আছে, তারাও তা গোপন করে রাখবে।” এর ফলে বাজারে ঘাটতি আরও তীব্র হবে এবং সংকট আরও গভীরতর হবে। তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন: “অভাবী ভোক্তারা যখন চাহিদা প্রকাশ করবে এবং সেই চাহিদা পূরণ না হলে, তখন তারা পণ্যের মূল্য আরও বাড়াতে উৎসাহিত হবে। এর ফলে দাম আরও বাড়বে এবং উভয় পক্ষ—ভোক্তা ও বিক্রেতা—দুই-ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
ন্যায্য মূল্য (Fair Price) ও সমতুল্য মূল্যের ধারণা : মুসলিম অর্থনীতিবিদদের চিন্তায় “কিমাত আল-মিথল” (সমতুল্য মূল্য) এবং “কিমাত আল-আদল” (ন্যায়সঙ্গত মূল্য) একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তবে, এ ধারণাটি গ্রীক দার্শনিকদের ন্যায়মূল্য (just price) ধারণা থেকে গৃহীত নয়; বরং এটি ইসলামী ঐতিহ্য থেকেই উদ্ভূত। নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং খলিফা উমর ও আলী—উভয়েই এই পরিভাষা ব্যবহার করেছেন (ইবনে হাম্বল, খণ্ড ৫, পৃ. ৩২৭; আল-রাদী, খণ্ড ৩, পৃ. ১১০; খণ্ড ৫, পৃ. ৩৪২)। ইবনে তাইমিয়ার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, “ন্যায়সঙ্গত মূল্য” হল সেই মূল্য যা একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের প্রাকৃতিক শক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হয় (ইসলাহী, ১৯৮৮, পৃ. ৮৩)। এর মধ্য দিয়ে তিনি প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের চেয়ে বাজার কাঠামোর ওপর আস্থার পক্ষে অবস্থান নেন।
মূল্য নিয়ন্ত্রণের সীমাবদ্ধতা ও ন্যায়সঙ্গত হস্তক্ষেপের স্বীকৃতি : যদিও ইবনে তাইমিয়া প্রশাসনিক দাম নির্ধারণের বিরোধিতা করেছিলেন, তার অনেক আগেই, দাম নিয়ন্ত্রণের তীব্র সমালোচক হিসেবে পরিচিত ইয়াহিয়া বিন উমর আল-কিনানিও নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সরকারি হস্তক্ষেপ সমর্থন করেছিলেন। যেমন, তিনি বলেন, যখন বাজারে অংশগ্রহণকারীরা (বিশেষ করে একচেটিয়াবাদী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী) মুনাফা লোভে কারসাজির মাধ্যমে পণ্যের মূল্য অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে তোলে এবং এতে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়—সেই পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষের উচিত মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করা । অর্থাৎ, তিনি বাজারব্যবস্থায় ব্যর্থতা বা অনিয়ম (market failure or collusion) দেখা দিলে ন্যায়সঙ্গত হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন।
(৪) অর্থনৈতিক চিন্তাধারায় ইসলামী ঐতিহ্য : উৎপাদন ও বণ্টন (Production and Distribution)
শিল্পের সংযোগ এবং আন্তঃনির্ভরতা (Linkages and Interdependence of Industries)
আল-গাজ্জালী শিল্পের আন্তঃনির্ভরতা (interdependence) তুলে ধরে বলেছেন, “কৃষক শস্য উৎপাদন করে, ঘানিত্তয়ালা তা ময়দায় রূপান্তর করে এবং রুটিওয়ালা রুটি তৈরি করে,” একটি উৎপাদন শৃঙ্খল (production chain) এর উপর জোর দিয়ে । তিনি আরও বলেন যে একজন কামার কৃষকের জন্য সরঞ্জাম তৈরি করে, অন্যদিকে একজন ছুতার কামারের জন্য সরঞ্জাম তৈরি করে – নির্ভরতার একটি চক্র (cycle of dependence) দেখাচ্ছে। আল-দিমাশকি এই কথাটি প্রতিধ্বনিত করে উল্লেখ করেছেন, “নির্মাতার ছুতার প্রয়োজন, ছুতারের লোহার প্রয়োজন” ইত্যাদি (১৯৭৭, পৃ. ২১)।
সহযোগিতা এবং শ্রম বিভাজন (Cooperation and Division of Labour)
আল-গাজ্জালী উল্লেখ করেছেন যে একটি রুটির জন্য এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক জড়িত থাকতে পারে এবং একটি সূঁচ তৈরিতে বিভিন্ন কারিগর জড়িত ২৫টি ধাপ (steps) প্রয়োজন, যা জটিল শ্রম বিশেষজ্ঞতা (labour specialization) তুলে ধরে। ইবনে খালদুন জোর দিয়ে বলেন যে সহযোগিতা (cooperation) এবং শ্রম বিভাজন (division of labour) উৎপাদনশীলতা (productivity) বৃদ্ধি করে, তবে তা বাজারের আকার (size of the market) দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে (১৯৬৪, খণ্ড ২, পৃ. ২৭১–২৭৪)। স্পেংলার (১৯৬৪, পৃ. ২৯৫–২৯৬) এটিকে উৎপাদন বৃদ্ধি (increasing output) এবং বাণিজ্যকে উৎসাহিত (fostering commerce) করার প্রক্রিয়া হিসেবে সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন।
(৫) বণ্টনের অর্থনীতি (Economics of Distribution)
লাভ (Profit)
আল-গাজ্জালী "পরকালের বাজারে" (market of the hereafter) নৈতিক বাণিজ্য (ethical trade) এবং আধ্যাত্মিক পুরস্কারের (spiritual rewards) জন্য ন্যায্য অনুশীলন (fair practices) এবং পরিমিত লাভের (moderate profit margin) উপর জোর দিয়েছেন, যা সাধারণত ৫–১০% । তিনি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থেকে অস্বাভাবিক মুনাফা (abnormal profits) চাওয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। ইবনে তাইমিয়্যা রিবহেল মা'রুফ (Ribh al-Ma’ruf – customary profit) সমর্থন করেছেন এবং গাবন ফাহিশ (Ghabn Fahish – excessive profit) এর বিরোধিতা করেছেন, বিশেষ করে যখন ক্রেতারা মুস্তারসিল (Mustarsil – uninformed buyer), অর্থাৎ একচেটিয়া মূল্য বৈষম্যের (price discrimination) শিকার হন (১৯৬৩, খণ্ড ২৫, পৃষ্ঠা ২৯৯–৩৬১)।
মজুরি (Wages)
ইবনে তাইমিয়্যাহ মজুরি নির্ধারণ (Tas’ir fil-A’mal – wage fixing) কে মূল্য নিয়ন্ত্রণের (price control) সাথে সমতুল্য করেছেন এবং গারার (Gharar – uncertainty) ও শোষণ (exploitation) রোধ করার জন্য উজরাত আল-মিথল (Ujrat al-Mithl – equivalent wage) এর উপর জোর দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে রাষ্ট্র (state) হয়তো অসম্পূর্ণ শ্রমবাজারে (imperfect labour market) হস্তক্ষেপ করতে পারে যাতে নিয়োগকর্তা (employer) এবং শ্রমিক (worker) উভয়ের জন্য ন্যায়বিচার (justice) নিশ্চিত করা যায় (১৯৭৬, পৃ. ৩৪; ১৯৬৪, পৃ. ১০৩)।
ভাড়া (Rent)
ইবনে খালদুন উল্লেখ করেছেন যে জমির ক্রমবর্ধমান মূল্য (rising land value) মালিকদের প্রচেষ্টা ছাড়াই অর্জিত আয় (unearned income) প্রদান করে, কারণ তারা কেবল রিয়েল এস্টেট বাজারের ওঠানামা (real estate market fluctuations) থেকে লাভবান হন – যা রিকার্ডিয়ান ভাড়ার
(৬) রাষ্ট্র, অর্থ এবং উন্নয়ন
ইসলামী রাজনৈতিক অর্থনীতি লেখা বনাম ফার্সি ‘রাজপুত্রদের জন্য আয়না’ (Persian ‘Mirrors for Princes’)
ইসলাম তার অনুসারীদের—সে শাসক হোক বা প্রজাজন—পরস্পরের প্রতি আন্তরিকতা [sincerity] এবং ন্যায়পরায়ণতা [justice] প্রদর্শনের শিক্ষা দিয়েছে এবং সর্বদা গঠনমূলক সমালোচনা [constructive criticism] ও ফলপ্রসূ পরামর্শ [fruitful counsel] প্রদানকে উৎসাহিত করেছে। এই কারণেই আমরা ইসলামী ঐতিহ্যে রাষ্ট্রপরিচালনা [statecraft] এবং সুশাসনের নিয়ম [rules for governance] নিয়ে লেখা একটি ধারাবাহিক রচনা দেখতে পাই, যা ইসলামী রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চিন্তাকে সমৃদ্ধ করেছে।
এ ধরনের লেখার অন্তর্ভুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আবু ইউসুফের কিতাব আল-খারাজ [Kitab al-Kharaj]। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে:
দাঈম আল-ইসলাম [Daʿaim al-Islam] — আবু হানিফা আল-নুʿমান আল-ইসমায়িলির রচনা,
আল-আহকাম আল-সুলতানিয়্যাহ [Al-Ahkam al-Sultaniyyah] — উভয়ই: আবু ইয়ালা আল-ফাররার ও আল-মাওয়ার্দীর রচনা,
সিয়াসাত নামাহ [Siyasat Namah] — নিজাম আল-মুলক আল-তুসির রচনা,
আল-তিবর আল-মাসবুক ফি নাসিহাত আল-মুলুক [Al-Tibr al-Masbuk fi Nasihat al-Muluk] — ইমাম আল-গাজ্জালির রচনা,
সিরাজ আল-মুলুক [Siraj al-Muluk] — আল-তুরতুশির রচনা,
কাবুস নামাহ [Qabus Namah] — কাই কাউসের রচনা,
আল-সিয়াসাহ আল-শরিয়্যাহ [Al-Siyasah al-Sharʿiyyah] — ইবনে তাইমিয়ার রচনা,
তাহরির আল-আহকাম ফি তাদবির আহল আল-ইসলাম [Tahrir al-Ahkam fi Tadbir Ahl al-Islam] — ইবনে জামাʿআহর রচনা।
(৭) রাষ্ট্র, ন্যায়বিচার ও ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠান
ক. ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা ও উপদেশমূলক সাহিত্য
খলিফা হারুন আল-রশিদ আবু ইউসুফকে (১৩৯২, পৃ. ৫) উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন: “আল্লাহ্ তোমাকে যা দিয়েছেন তার প্রতি যত্নবান হও এবং তোমার উপর অর্পিত কর্তৃত্বের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করো।”
এরই অনুরূপভাবে, ইবনে তাইমিয়াহ (১৯৭৬, পৃ. ৯৪) বলেন: “ন্যায়পরায়ণ সরকার, তা যদি অবিশ্বাসীও হয়, টিকে থাকতে পারে; কিন্তু অন্যায় সরকার, তা মুসলিম হলেও, টিকবে না।” এই দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামী শাসনব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তিকে তুলে ধরে। শাসক এবং প্রশাসনিক কাঠামোর প্রতি উপদেশমূলক লেখা ইসলামী সাহিত্যজগতে একটি স্বতন্ত্র ধারার জন্ম দেয়, যা শাসকদের জন্য উপদেশগ্রন্থ বা 'আল-হিসবাহ' সাহিত্য হিসেবে পরিচিত।
খ. আল-হিসবাহ : নৈতিক-অর্থনৈতিক তত্ত্বাবধান
ইসলামী ঐতিহ্যে আল-হিসবাহ একটি বিশেষ ধরনের সাহিত্য ও প্রশাসনিক ধারণা, যার মাধ্যমে রাষ্ট্র জনজীবনের ওপর নৈতিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত থাকে। আল-মুবারক (১৯৭৩, পৃ. ৭৩–৭৪) অনুসারে, এটি এমন এক ধরনের প্রশাসনিক তত্ত্বাবধান, যার উদ্দেশ্য ছিল সমাজে ধর্মীয় নীতি ও প্রচলিত রীতিনীতি অনুযায়ী সুশাসন নিশ্চিত করা।
মুহতাসিব হলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত এক কর্মকর্তা, যার দায়িত্ব ছিল সমাজে আর্থ-সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা। তাঁর প্রধান কার্যাবলি হল:
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যোগান নিশ্চিতকরণ
উৎপাদনশীল পেশাজীবীদের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান ও শিল্প বিরোধ নিষ্পত্তি
ওজন ও পরিমাপের মাননিয়ন্ত্রণ
ভেজাল রোধ, মজুতদারি, অলিগোপলিস্টদের চুক্তি নিয়ন্ত্রণ
প্রয়োজনে মূল্য, মজুরি এবং ভাড়া নির্ধারণ
গ. পাবলিক ফাইন্যান্স ও করনীতি (Public Finance and Taxation)
ইসলামী অর্থনীতির ইতিহাসে কিতাব আল-খারাজ এবং কিতাব আল-আমওয়াল ছিল ২য়/৮ম শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ যা রাজস্বব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার ভিত্তি স্থাপন করে। এগুলোর রচয়িতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
আবু ইউসুফ, আল-কুরাশী, আবু উবাইদ, ইবনে জানজাওয়াইহ, আল-দাউদী, ইবনে রজব, কুদামা ইবনে জাফর, এবং আল-মাখজুমি।
ইসলামী কর ব্যবস্থার প্রকারভেদ ও পণ্ডিতদের মতামত
১. উশর (১০%) ও খারাজ (ভূমি কর): প্রাথমিক যুগে মুসলিম রাষ্ট্রের রাজস্বের প্রধান উৎস (আবু ইউসুফ, কিতাব আল-খারাজ)।
২. মিসাহা (স্থায়ী ভূমি কর): ভূমির উৎপাদনশীলতার ভিত্তিতে নির্ধারিত কর, যা খলিফা উমরের সময় চালু হয়।
৩. মুকাসামাহ (আনুপাতিক কৃষি কর): আবু ইউসুফ মিসাহার পরিবর্তে এই কর ব্যবস্থার সুপারিশ করেন, যা উৎপাদন অনুপাতে আদায় হতো।
৪. জিযিয়া (পোল ট্যাক্স): অমুসলিম নাগরিকদের উপর আরোপিত কর, যা আয়ের ক্ষমতার ভিত্তিতে নমনীয়ভাবে নির্ধারিত হতো।
৫. গনিমাহ, সাদাকাহ, ফায়’: ইবনে তাইমিয়াহ (আল-সিয়াসাহ আল-শর’ইয়াহ) এই সব রাজস্বকে শরিয়াহসম্মত বলে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন।
৬. অতিরিক্ত (শরীয়াবহির্ভূত) কর: এই বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। প্রয়োজনে কিছু পণ্ডিত যেমন ইবনে হাজম, আল-গাজ্জালি, ইবনে তাইমিয়া ইত্যাদি এটিকে বৈধ মনে করলেও, অন্যরা (যেমন আল-নওয়াবি, আল-সুয়ুতি) তা বিতর্কিত হিসেবে অভিহিত করেছেন।
সরকারি ঋণ (Public Borrowing) : প্রাথমিক পণ্ডিত যেমন আবু ইয়ালা ও আল-মাওয়ার্দী, শুধুমাত্র জরুরি অবস্থায় রাষ্ট্রীয় ঋণ গ্রহণের অনুমোদন দিয়েছেন, অপব্যবহার ও জবরদস্তিমূলক কর আরোপের আশঙ্কায়।
পরবর্তীকালে, আল-গাজ্জালি ও আল-জুয়াইনি রাষ্ট্রীয় আয় থেকে ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা থাকলে তা বৈধ বলে মত দিয়েছেন (আল-মাওয়ার্দী, ১৯৭৯, পৃ. ২১৪; আল-গাজ্জালি, পৃ. ২৪১)।
সরকারি ব্যয় (Public Expenditure) : পণ্ডিতগণ আমওয়াল আল-মাসালিহ অর্থাৎ জনকল্যাণে ব্যয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, এবং ফরজ কিফায়ার কাজকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
আবু ইউসুফ সাধারণ উপকারভোগী প্রকল্প ও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীভিত্তিক প্রকল্পের মধ্যে পার্থক্য করেছেন । আল-গাজ্জালি (খণ্ড ২, পৃ. ১৬৬) এবং আল-মাওয়ার্দী (১৯৭৯, পৃ. ২১৫) একই ধারণা তুলে ধরেন।
সর্বোপরি, ইসলামী চিন্তাধারায় উন্নয়নের (Development) সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি একাধিক আন্তঃসংযুক্ত উপাদানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে—বিশ্বাস, ন্যায়বিচার, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক কাঠামো। ইবনে খালদুন উন্নয়নের একটি পাঁচ-ধাপবিশিষ্ট চক্রাকার মডেল উপস্থাপন করেন। প্রথম ধাপে থাকে বিজয় এবং গোষ্ঠীগত সংহতি (‘আসাবিয়্যাহ’), যেখানে শাসকরা আদর্শ নেতৃত্ব প্রদর্শনের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় ধাপে শাসনব্যবস্থা সুসংহত হয় এবং ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। তৃতীয় ধাপে দেখা যায় অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ, সমৃদ্ধি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন। চতুর্থ ধাপে আসে স্থবিরতা, যখন শাসকরা নতুন কোনো উদ্ভাবন না করে পূর্বসূরীদের উত্তরাধিকারেই নির্ভর করেন। পঞ্চম ও চূড়ান্ত ধাপে বিলাসিতা, অপচয় এবং দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়, যার ফলে কর বাড়ে, রাজস্ব হ্রাস পায়, নৈতিক অবক্ষয় ঘটে এবং অবশেষে সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এরপর নবায়িত ‘আসাবিয়্যাহ’র মাধ্যমে একটি নতুন গোষ্ঠীর উত্থানের মাধ্যমে এই চক্র আবার শুরু হয় (ইবনে খালদুন, ১৯৬৭, খণ্ড ১ ও ২)।
তথ্যসূত্র
Abu-Yusuf (1392), Kitab al-Kharaj, Cairo, Dar al-Matba`ah al-Salafiyyah.
al-Dimashqi, Abu’l-Fadl Ja‛far (1977), al-Isharah ila Mahasin al-Tijarah, edited by al-Shorabji, Cairo, Maktabah al-Kulliyyat al-Azhariyyah.
Al-Maqdisi, Ibn Qudamah (1972), al-Sharh al-Kabir (Printed at the foot of alMughni by Ibn Qudamah, Beirut: Dar al-Kitab al-Arabi, 12 Vols.
Ibn al-Jawzi, Abd al-Rahman (1962), Dhamm al-Hawa, (edited by Abd alWahid, Mustafa), n. p.
Ibn Khaldun (n.d.), Muqaddimah, Beirut, Dar al-Fikr. Ibn al-Qayyim (1955), I`lam al-Muwaqqi`in, Cairo, Maktabah al-Sa`adah.
Ibn Rushd. (1988). Bidayat al-Mujtahid. Beirut: Dar al-Maʿrifah.
Ibn Taymiyyah. (1963). Majmūʿ Fatāwā Shaykh al-Islām Aḥmad Ibn Taymiyyah (ʿAbd al-Raḥmān b. Muḥammad al-Najdī, Ed.). Al-Riyadh: Maṭābiʿ al-Riyāḍ.
Ibn Taymiyyah. (1964). Al-Masāʾil al-Mardiniyyah. Damascus: al-Maktab al-Islāmī.
Ibn Taymiyyah. (1971). Al-Siyāsah al-Sharʿiyyah. Cairo: Dār al-Shaʿb.
(English translation: Farrukh, O. (1966). Ibn Taimiyya on Public and Private Laws in Islam. Beirut: Khayats.)
Ibn Taymiyyah. (1976). Al-Ḥisbah fī al-Islām. Cairo: Dār al-Shaʿb.
(English translation: Holland, M. (1982). Public Duties in Islam: The Institution of the Hisbah. Leicester: The Islamic Foundation.)
Ibn Taymiyyah. (1986). Mukhtaṣar al-Fatāwā al-Miṣriyyah (Muḥammad al-Baʿlī, Ed.). Dammam: Dār Ibn al-Qayyim.
Islahi, A. A. (2005). Contributions of Muslim scholars to the history of economic thought and analysis up to 15th century. Islamic Economics Institute, King Abdulaziz University. Munich Personal RePEc Archive (MPRA) Paper No. 53462. Retrieved from https://mpra.ub.uni-muenchen.de/53462/
Roll, E. (1974). A history of economic thought. Homewood, IL: Richard D. Irwin, Inc.